Pages

Thursday, September 25, 2014

শহরে থাকার আবশ্যকতা

৮০ সালের দিকে প্রাইমারী স্কুলের স্টুডেন্ট থাকতে যখন গ্রামে যেতাম, তখন গ্রামে দুই/তিন দিনের বেশী থাকতে পারতাম না। কারণ গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। গ্রামে গিয়ে তখন শহরে(কুমিল্লা) আসার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। মামারা/চাচারা আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত। আমাদের উত্তরটা ছিল বিদ্যুৎ নাই। রাতে ভয় লাগে। ভাল লাগে না। একসময় গ্রামে বিদ্যুৎ আসল। তখন আবার আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল বিদ্যুৎ আছে ঠিকই। তা বেশী সময় থাকে না। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যায়। আবার রাস্তাঘাট ঠিক নাই। ক্যাবল টিভি নাই। সাপ্লাই পানি নাই। ঘরবাড়ী পাকা নাই। অত:পর কালের পরিক্রমায় গ্রামে রাস্তাঘাট পাকা হল। ঘরবাড়ী পাকা হল। মোটরে ট্যাংকিতে পানি তুলে টেপের পানি হল। ক্যাবল টিভি আসল। আইপিএস লাগানো গেল। মোবাইল নেটওয়ার্ক আসল। সাথে ইন্টারনেটও পাওয়া যেতে লাগল। আর কি বাকী থাকল?
সাপ্লাই গ্যাস লাইন কোথায়। তারও প্রয়োজন নেই। গ্রামের বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। আর কি বাকী থাকল?
অবশ্য আমি কুমিল্লা জেলার ক্যান্টনমেন্টের উপজেলা বুড়িচং এর পাশে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার গ্রামের কথা বলছি। যেখানকার অগ্রগতি দেশের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চল থেকে অগ্রগামী।
গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় বাকী থাকল আর তা হল ভাল স্কুল, শিক্ষিত বন্ধু ও চিকিৎসা। এ তিনটি বিষয় শিক্ষিত মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তাই গ্রামে বেড়াতে যাওয়া যায় কিন্তু স্থায়ীভাবে থাকাটা পছন্দের হবে না।
চিকিৎসা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা পেতে গ্রামে সমস্যা।
এখন আমি আমার একটা পরিস্থিতি বর্ণনা করি। আমি আমার মত একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা অবসর পরবর্তী গ্রামীণ জীবনে থাকার পরিকল্পনা তুলে ধরব। তার আগে আমার পিতার গ্রামীণ জীবন তুলে ধরি। আমার পিতা ১৯৯১ সালে  বিটিএন্ডটি (বর্তমান বিটিসিএল)  এর ইঞ্জিনিয়ার পদ থেকে রিটায়ার করার পর গ্রামে গিয়েছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর গ্রামে ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। ২০১৩ সালে স্ট্রোক করার পর ৮১ বছর বয়সে শয্যাশায়ী হয়েছেন। যদি শহরে থাকতেন, তবে ভাল থাকতেন, সে গ্যারান্টি দেয়া যায় না। কারণ শহরের অবস্থানরত তার কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু ৬০/৬৫ বছর বয়সে ডায়াবেটিকসে ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ৮০ বছর বয়সে স্ট্রোকের আগ পর্যন্ত তিনি কোন রকম রোগের সমস্যায় ছিলেন না। সকালে ফজর নামাজের পর তার দিন শুরু হত। টুক টুক করে এক দুই জন লেবার নিয়ে সব্জিবাগান, ফলবাগান, পুকুরের মাছ, হাস-মুরগী, গরু, ছাগল ইত্যাদি নিয়ে তিনি তার ফার্মিং হাউসে ব্যস্ত থাকতেন। কাজ শেষে বিকালে পত্রিকা পড়া আর টিভি দেখার কাজগুলো করতেন। গ্রামের মানুষ ডাক্তার দেখানোর মত তার কাছে আসত বিভিন্ন পরামর্শের জন্য। অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার গ্রামের মানুষের কাছে ছিল একজন সম্মানিত পরামর্শদাতা। গ্রামের মানুষের মাঝে চায়ের দোকান বা উঠোনে আড্ডা দেয়ার একটা অভ্যাস লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমার বাবা (এম এ মালেক সরকার) বিভিন্ন ফামিংএ এত ব্যস্ত থাকতেন যে আড্ডা মারার সময় ছিল না। তিনি শারীরিকভাবে ছিলেন যথেষ্ট ফিট। একবার হেটে হেটে তিনি আমাকে জমি দেখাচ্ছিলেন। ঘন্টাখানেক হাটার পর আমি সেদিনের মত ফেরত আসতে চাইলাম। তিনি টিপ্পনী কাটলেন, তুমি না মিলিটারি অল্পতে দমলে চলবে? আমি লজ্জা পেয়ে বাকী পথটুকু বিনাবাক্য তার সাথে হাটতে শুরু করলাম। আমার বাবার শহর থেকে গ্রামে যাওয়াটা ছিল আমার জন্য একটা প্রেরণা। আমার বাবা রিটায়ার করার পর ১৯৯১ সালে যখন ঢাকার বাড়ীতে না থেকে গ্রামে যেতে চাইল, আমার সকল ভাইবোন বিরোধিতা করল। আমি আমার বাবার পক্ষে থেকে তাকে উৎসাহ দিলাম। তিনি বললেন, “শহরে থাকলে আমি মসজিদে যাব। পত্রিকা পড়ব । দুইদিন পর ডায়াবেটিস আর ব্লাড প্রেশার হয়ে মারা যাব। অথচ গ্রামের বাড়ী থেকে বেরুলে অন্তত আমার আত্নীয় স্বজনরা সালাম দিবে আর আমার ভালমন্দ কুশলাদি জানতে চাইবে। ঢাকাতে হাজার মানুষের হাজার ব্যস্ততায় এ আন্তরিকতাটুকু কারো কাছে পাব না। সারা জীবন নিজ গ্রামের মানুষ থেকে দূরে থাকলাম শেষ বয়সে অন্তত তাদের পাশে থাকিআমি তাকে শর্ত দিলাম, পেনশনের টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়ীতে উন্নায়নমুলক কাজগুলি করবেন। যেমন: পাকা বাড়ী, পাকা বাথরুম, বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর ইত্যাদি ইত্যাদি। গ্রামে থাকার সময় ভিলেজ পলিট্রিস্ পাস কাটিয়ে চলবেন। তারপর থেকে আমার বাবা দীর্ঘ ২১ বছর গ্রামে কাটাচ্ছেন। এখন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হওয়ার পর তাকে যখন ঢাকা বা কুমিল্লায় শহরে থাকতে অনুরোধ করা হয়। তাতে তিনি রাজী নন। তিনি তার পরিবেশে গ্রামেই থাকবেন। আমাদের যেটা করতে হয় অসুস্থ হলেই বাবাকে আর মাকে এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের সিএমএইচে আনতে হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসের পাশে বেসরকারি ময়নামতি হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে বাড়ীতে পাঠিয়ে তাদের সিএমএইচ, কুমিল্লায় আনার ব্যবস্থা করা যায়। গ্রাম থেকে সিএমএইচে আনতে প্রয়োজন আনুমানিক একঘন্টা সময়। তবে ঢাকার রাস্তায় জ্যামে এর চেয়ে বেশী সময় লাগতে পারে।
আমার বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য আমার জন্য কিছু অপশন রয়েছে। তবে সে পযর্ন্ত বেচে থাকার উপর নির্ভর করছে পরিকল্পনাগুলো। আমার চাকুরী রয়েছে ২০২১ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ এখনও ৭ বছর বাকী (এ লেখাটি লিখছি সেপ্টেম্বর ২০১৪) । ৭ বছরে আমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হয়তবা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়বে। যদি তাকে ক্যাডেট কলেজ জাতীয় আবাসিকে দিতে পারি তবে তখন থেকেই গ্রামের জীবনের পরিকল্পনায় যাওয়া যাবে। অন্যথায় কনিষ্ঠ মেয়ে প্রকৌশলী বা ডাক্তারির জন্য আবাসিক ব্যবস্থায় চলে গেলে তখন গ্রামের পথে হাটা যাবে। এখন গ্রামের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।  জেলা শহরে কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান জাতীয় ব্যবসা করলে শহর ছেড়ে বেশী দুরে গ্রামে গেলে সমস্যায় পড়ব। এগ্রো বেইজড কোন ব্যবসা করলে গ্রামে থাকাটা আরও বেশী কার্যকর হবে। শহরের উপকণ্ঠে থাকলে গ্রামীণ পরিবেশ পাওয়া যাবে। সেইসাথে শহরে দ্রুত যাওয়া যাবে।
তাহলে গ্রামে থাকতে হলে নীচের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হচ্ছে:
১। স্কুলিং।
২। চিকিৎসা ।
৩। শিক্ষিত বন্ধু বান্ধবের অভাব।
এই তিনটি চ্যালেঞ্জই বর্তমানে শহরে বসবাসরত পরে গ্রামে যেতে যায় তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে। মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তদের জন্য এগুলো চ্যালেঞ্জ নয়। এগুলো অতিক্রম করার জন্য যে প্রক্রিয়া করা যেতে পারে সে আলোচনা করা যাক।
প্রথমত: গ্রামের স্কুল থেকে ভাল রেজাল্ট ধারীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। তাই গ্রামে থেকে ভাল ফলাফল সম্ভব নয় কথাটা ঠিক নয়। ইংরেজি ভার্সন আর মিডিয়াম পড়নো সম্ভব নয়। শহরে মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করে পড়ানোর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষিত পিতামাতাকে সন্তানদের সরাসরি যত্ন নিতে হবে। অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্য নিতে হবে। আর কিছুদিন পর গ্রামেও থ্রিজি ইন্টারনেট চলে আসবে।
দ্বিতীয়ত: চিকিৎসার জন্য নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার ডাক্তারের কাছে যেতে হলে তার জন্য পরিচ্ছন্ন হাওয়ার নির্মল গ্রামের জীবন প্রযোজ্য নয়। ডায়াবেটিসের কারনে নিয়মিত ইনসুলিন নেয়া পার্টি, ক্যান্সার আক্রান্ত কেমো  ইত্যাদির দলভুক্ত মানুষগুলো গ্রামের জন্য আনফিট। সাধারণ গ্রামের মানুষ সাধারণত রোগ নিয়ে সচেতন নয়। তাই হঠাত করে অসুখে ভুগে ‘আল বিদা’ করে ফেলে। তারা জানতেও পারেনা আসলে কি অসুখে ভুগছিল। তবে বিষয়টা হল মরণশীল মানুষ কোন না কোনভাবে মরবেই। আগে আর পরে। অনেক সময় ক্যান্সারের রোগী নিজের সর্বস্ব শেষ করে আর সন্তানদের সর্বস্ব শেষ করে ফাইনালি যখন ‘আল বিদা’ বলে তখন সুদূর অন্ধকার দিনগুলো পড়ে থাকে উত্তরাধিকারীদের জন্য। মরে গিয়ে মেরে যাচ্ছে সবাইকে। আমরা সবাই এ কামনা করি, যেন আমরা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় না থেকে হুট করে মরে যাই। দীর্ঘ সময় বিছানায় পরে থেকে মৃত্যু কারো কাম্য নয়। সুতরাং নিয়মিত রুগী না হলে গ্রামে থাকা সমস্যা নয়। যে কোন বিপদে আপদে প্রাথমিক ভাবে পল্লী চিকিৎসক গন প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা বড় ডাক্তারদের নির্দেশনা মত দিতে পারবে আর রোগী এ্যাম্বুলেন্সে শহরমুখী হবে। তাই চিকিৎসা হবে না এটা গ্রামে থাকার প্রতিবন্ধকতা নয়। উপজেলায় ডাক্তার থাকায় এখন গ্রামের ২০/২৫ কি:মি: মধ্যে ডাক্তার থাকার সম্ভবনা আছে।
আমাদের সর্বশেষ পয়েন্ট যেটি থাকল আর তা হল শিক্ষিত বন্ধু।
শিক্ষিত বন্ধু: শিক্ষিত বন্ধু কি সর্বদা ভাল হবে। হ্যা বা না। চাকুরী ছাড়ার পর আমার এক বন্ধুকে দেখলাম শহর থেকে কিছু দুরে তার অবস্থান। বন্ধুদের সান্নিধ্য শহরে মাঝে মাঝে আগমন। ক্লাবের টেনিস, ব্রিলিয়ার্ড, সুইমিংপুল ও বন্ধুদের সংগ। ভাল মন্দ খাওয়া দাওয়া করে মনটাকে চার্জ আপ করে পুনরায় শহরের উপকণ্ঠে নিজ ঢেরায় ফিরে আসা। আর মাঝে মাঝে রাজধানীতে গিয়ে বা অন্য শহরে গিয়ে বন্ধুদের গেটটুগেদার করা যায়।
তাহলে গ্রামে পড়াশোনার ব্যবস্থা হল, চিকিৎসা হল এবং শিক্ষিত বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল এখন আর গ্রামে থাকতে সমস্যা নাই। আমি যদি আমার অবসর জীবনে গ্রামে থাকার চিন্তা করি তবে তার একটা রূপরেখা হতে পারে এরূপ:
(১) এক থেকে দুই বিঘা জমি থাকবে।
(২) মাস চাষের জন্য ছোট পুকুর থাকবে।
(৩) বিভিন্ন ধরনের ফল বাগান থাকবে।
(৪) বিভিন্ন ধরনের সব্জি বাগান থাকবে।
(৫) বন্যা মুক্ত করার জন্য উঁচু করে দুই তলা বাড়ী। নীচের তলায় গ্যারেজ,ষ্টোর ও সাভেন্টস কোয়ার্টার। দ্বিতীয় তলা দেয়াল দেয়া টিন শেড। টিন শেড করার কারণ রেইন ওয়াটার হারবেস্ট করা এবং খরচ কমানো।
(৬) গরু,ছাগল ও হাস মুরগীর প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট কষ্টকর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রাখা যায় না তবে ভূমিতে চড়ে বেড়ানো জীবিত প্রাণীর চাষাবাদ আপাতত আমার গ্রামের বাড়ীর পরিকল্পনায় নাই।
(৭) শহরের উপকণ্ঠ গ্রামটি হলে গাড়ী থাকবে। অন্যথায় সে স্থানের চলাচল উপযোগী বাহন থাকবে।
(৮) সোলার সিস্টেমের পাশাপাশি আইপিএস ও জেনারেটর থাকবে। কমপক্ষে দুইটি রুমে এসি থাকবে।
এ হল আমার গ্রামের বাড়ীর একটা প্রাথমিক ধারনা। আমরা এখন শহরগুলোতে ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকায় মধ্যম মানের ছোটোখাটো ফ্লাট ক্রয় করি। আশা করি অনুরূপ টাকায় গ্রামের বাড়ীর এ প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করা যাবে।
এ ধরনের বাড়ী আমার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের রিটারমেন্টের পর কি কি চাহিদা পূরণ হবে?
         নির্মল ও মুক্ত বাতাস পাওয়া যাবে
         সুন্দর পরিবেশে সকাল বিকাল হাটা যাবে।
         নিজে উৎপাদিত ফ্রেশ সব্জি ও ফল পাওয়া যাবে। কিছু খাওয়া, কিছু উপহার পাঠানো ও কিছু বিক্রি করা যাবে।
         ফ্রেশ মাছ পুকুর থেকে প্রতিনিয়ত জাল দিয়ে ধরা যাবেএছাড়া বড়শী দিয়েও মাছ ধরা যাবে
         কোলাহল মুক্ত পরিবেশে লেখালেখি করার জন্য পরিবেশটা মন্দ নয়।

সাপ্লাই বিদ্যুৎ, সোলার, ব্যাটারি  ও জেনারেটরের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যু প্রাপ্তি আর তেমন সমস্যা নয়। এ যুগে মনে হয় গ্রাম, শহর আর দেশের দুরত্ব কমে কমে গেছে। ইন্টারনেট আর নেটওর্য়াকের যুগে পৃথিবী একত্রীভূত। গ্রাম আর শহরে থাকাটা নিজ নিজ ভাল লাগা আর খারাপ লাগার অনুভুতি। তবে সাধারন মানুষের পাশে শিক্ষিতরা থাকলে আমারদের গ্রামগুলি আরো এগিয়ে যাবে।

Friday, September 12, 2014

চাকুরী:পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে বস

সামরিক বাহিনীর সিনিয়র ও জুনিয়ার মর্যাদা ও সম্মানের লড়াইটা অনেক অনেক বেশী দৃঢ় ও কঠিন। তাই মিলিটারি একাডেমীতে যে জুনিয়ারকে রগড়া দিল আজ যখন সে বস তা ভয়ানক পীড়াদায়ক। আবার চাকুরীর মেয়াদ পূর্তির পূর্বে চাকুরী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজন ইমোশনাল হওয়া ও বাইরে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য ভিত্তি।
২০০৭ সালে কঠিন এক বসের কাছে মন্দ ব্যবহার পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আসন্ন দ্বিতীয় মিশন শেষ করে চাকুরী ছেড়ে দিব। কম্পিউটারের দোকান দিব। অনলাইন পত্রিকা চালাব। লেখালেখি করব। কম খরচে চলার জন্য বগুড়ায় থাকব(১০,০০০ টাকায় মান সম্পন্ন ডি টাইপ বাসা পাওয়া যায়) পেনসনের টাকা ব্যাংকে রেখে লাভ নিব। ঢাকা, কুমিল্লার পৈত্তিক বাড়ীর ভাড়া, জমির আয় ও বগুড়ার স্ত্রীর জমির বাড়ীর আয়। এছাড়া এএইচএস পেলে তার কিছু ফ্লাট বিক্রি ও ভাড়ায় খাটানো যাবে। সমস্ত আয় যোগ করে নিলে চালক সহ পুরাতন কার, বাসায় দুটি এসি(সোলার পাওয়ারে চালানো যেতে পারে) ও বাচ্চাদের বগুড়ার ক্যান্টনমেন্টে ইংরেজি ভার্সনে পড়ানো যাবে। চিকিৎসা সহায়তা হয়ত বগুড়া সিএমএইচে নেয়া যাবে। বেশী ক্রিটিক্যাল হলে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা নেয়া যাবে।
বেশ সুন্দরভাবে পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। লোভে পরে শেয়ার মার্কেটে ঢুকলাম তারপর থেকে আমার বিপদ শুরু শেয়ারে ধস। ব্যাংকে পেনশনের বিপরীতে অগ্রিম লোণ। সব কিছু থেকে রেহাই পেলাম দ্বিতীয় মিশনের টাকা শেষ করে। যা ঘটল কোমর ভেঙ্গে গেল। চাকুরী ছাড়ার চিন্তা সাময়িকভাবে  বাদ দিতে হল।
মিশন থেকে এসে প্রথম হয়রানী হল জুনিয়ার কোর্সের কর্মকর্তাকে অধিনায়ক হিসাবে পাওয়া। নিজেকে প্রবোধ দিলাম চাকুরী ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত জুনিয়ারের পেঁদানি খেতেই হবে। আমরা চাকুরীতে যেটা মেনে নিতে পারি। সামাজিক ভাবে বসবাসরত আমদের পরিবারের জন্য তা কষ্টকর। তারপর কুরআনের বানী,আল্লাহ যাকে ইচ্ছে রাজত্ব দিতে পারেন, যখন খুশী কেড়ে নিতে পারেন একজন লে: কর্নেল যে কিনা সেনাপ্রধানও হতে পারত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে হাজতবাস করতে হচ্ছে।
আমার এক কোর্স-মেট সেও বিজিবিতে পোস্টিং পাওয়ার পর তার স্ত্রী আমার স্ত্রীকে বলল, “বিজিবিতে একটাই সমস্যা ঘন ঘন পোস্টিং আর জুনিয়ারের অধীনে চাকুরী করতে হয়। আর জুনিয়ারের স্ত্রীকে রিসিভ করার জন্য ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকা আরও কষ্টকর
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম সমস্যাটা মানসিক তাই এর চিকিৎসাটাও মানুষিক-ভাবে করতে হবে। প্রথমত: তুমি যদি মনে কর,স্বামী থেকে র‍্যাংকে সিনিয়র আর চাকুরীতে জুনিয়ার কাউকে রিসিভ করতে ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছ তাহলে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বাধবে। যদি মনে কর,সম্মানিত ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে যত্নের সাথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছ আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে, তবে এ কষ্টটা আর পাবে না। কারন সরকারী প্রতিষ্ঠানে ঝাড়ুদার থেকে অধিনায়ক সকলেরই কম বেশী গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আছে। সেখানে নিজেকে তুচ্ছ ভাবার কারণ নেই। আর অফিসারদের আমরা ব্রাদার অফিসার মনে করি।
সে যাক গে, আমার স্ত্রীর অবশ্য ফুল হাতে দাড়িয়ে থাকতে হয়নি বা অন্য কোন অনাচারে পড়তে হয়নি।
পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে র‍্যাংকে সিনিয়র বসের সাথে চাকুরী করা সহজ বলব না। এটা আসলেই চ্যালেঞ্জিং বিষয় যেটা হয় এতে প্রয়োজন ভয়ানক রকম ইমোশন নিয়ন্ত্রণ। কঙ্গো মিশনে( ২০১১-১২) কন্টিনজেন্টের টুআইসি ও অপারেশন অফিসারের দুইজন যারা পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে র‍্যাংকে লে: কর্নেল তাদের সাথে ক্রিটিক্যাল চাকুরী করার কারণে জুনিয়ার বস নিয়ে চাকুরী বিষয়ে ভাবনার মধ্যে পরিনি।
পোস্টিং হওয়ার পর আমি পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে র‍্যাংকে সিনিয়র অধিনায়ককে ফোন দিলাম।অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে প্রথম প্রশ্ন, আপনি কি সপরিবারে আসছেন। আমি হ্যাঁ সূচক বলায় খুবই খুশি হয়ে বলল,” আমার স্ত্রী ও সন্তানরা একাকী আছে। পরিবারের সংখ্যা বাড়লে তাদের খুশী। আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
জয়েন করার পূর্বে আমি ইন্ট অফিসারের সাথে বাসার বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করলাম। ইন্ট অফিসার আমাকে যা বলল তাতে আমি একটু অবাকই হলাম। সে জানাল, অধিনায়ক ব্যারাক এনসিও, এসএম ও ইন্ট অফিসারকে নিয়ে আমার জন্য বরাদ্দকৃত কোয়ার্টারে কি কি কাজ করতে হবে তা দেখিয়েছেন এবং বাসার অনেক উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছেএ বিষয়টিতে মনে হয়েছে অধিনায়ক বেশ কেয়ারিং। অধিনায়ক তার অধস্তন কর্মকর্তার বাসার উন্নয়নের জন্য চিন্তা করবেন বাঙ্গালী মানসিকতায় এটা ভাবাই যায় না।
ইউনিটে আসার পর ইন্ট অফিসার উপস্থিত হয়ে স্বাগত জানাল এতে সত্যি মনটা বেশ ভাল হল। অফিসের প্রথম সাক্ষাতে অধিনায়ক বলল, প্রাতিষ্ঠানিক কারণে আপনি সিনিয়র হয়েও আমার টুআইসি। আপনার কাছ থেকে আমি যথাযথ সহযোগিতা আশা করছি। আমি তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কাজ শুরু করলাম। ২২ বছর চাকুরীতে এসে আমি ৩০০ রিক্রুটদের ওআইসি হলাম। এতে একটা বিষয় হল, আমাকে নিয়মিত পিটিতে যেতে হত ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকছিল। আর একজন মেজর থাকায় কাজের চাপ ভাগ হচ্ছিল। বিপত্তিটা তখন বাধল যখন ইন্ট অফিসারের বদলী হল। এমনকি কোন এডি(ডিপার্টমেন্টাল অফিসার) নাই। রিক্রুট ওআইসি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিক্রুটদের সমস্ত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, টুআইসির দায়িত্ব, আপস অফিসারের দায়িত্ব, সোর্স হ্যান্ডেলিং ও প্রায়শই রাতে অপারেশন। জীবন মোটামুটি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যে অধিনায়কের আদেশ, কোন গাড়ী পাঠাতে হলে তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনে কমপক্ষে ২০/৩০ বার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে হয়। মাঝে মাঝে ফোনে অধিনায়ককে না পাওয়া গেলে এসএমএস দিতে হত।
সামরিক ইউনিটের এ্যাডজুট্যান্টকে এত চাপ সহ্য করতে হয় না যা বৃদ্ধ বয়সে বিজিবি,র মেজরকে করতে হয়।
জুনিয়ার অধিনায়কের সাথে আমাকে জানুয়ারি ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০১৩ আট মাস চাকুরী করতে হয়েছে এর মধ্যে দুইবার ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। তখন আমাকে বিনয়ের সাথে বলতে হয়েছিল, আমাকে দিয়ে যদি ইউনিট চালাতে সমস্যা হয় অনুগ্রহ করে যে কোন ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করতে পারেনএগুলো বলার কারণ আমার চাকুরীর রেকর্ডে কোন শাস্তি নেই। আর প্রমোশন অতিক্রান্ত হয়ে এখন শাস্তি পেলে কি ক্ষতি হবে তা আমার জানা নেই। আর আমাকে যদি ফোর্স রিটায়ার করতে হয় তবে তা মন্দ নয়। কারণ চাকুরী নিজে থেকে ছাড়ার পথে পরিবার প্রধান অন্তরায়। যদি কেউ জোর করে অব্যাহতি দেয় তবে তা হয়ত ভাল হবে। পরিবারের কাছে আর দায় থাকবে না।
আমার স্ত্রী সাথে জুনিয়ার অধিনায়কের স্ত্রীর কখনও মনঃকষ্টের বিষয় ঘটেনি। কারণ আমার স্ত্রী ভাল শ্রোতা হওয়ায় কখনও সমস্যায় সে পড়েনি। উচ্চতর র‍্যাংকের অফিসারের পত্নীরা স্বাভাবিকভাবেই সফলতার গল্প করতে পছন্দ করেন। আর আমার স্ত্রী বেশ চুপচাপ তা শোনার অভ্যাস করে ফেলেছে।
চাকুরীতে জুনিয়ার ও র‍্যাংকে সিনিয়র অধিনায়কের সাথে চাকুরীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিরোধ হতে পারে। গাড়ী নিয়ে বিরোধ। নিজের কারটি প্রস্তুত রাখলে সমস্যা কম হবে। অফিস ও বাসায় খবরের কাগজ,টিস্যু পেপার ইত্যাদি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু নিজ খরচে চললে ভাল থাকা যাবে। ইউনিটের সব্জি বাগান, ফল ফলাদি ও পুকুরের মাছ ইত্যাদি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলে বিরোধ কম হবে। এগুলো সমস্ত কিছু মিলিয়ে এক থেকে দুই হাজার টাকার বেশী লাভ নাই কিন্তু ইজ্জত যেতে পারে ও খামাখা ঝামেলা বাড়তে পারে। মেস-ওয়েটার ও কুক বিনা পারিশ্রমিকে খাটানো মেজর র‍্যাংকে ঠিক নয়। ব্যক্তিগত পার্টির বা কাজের শেষে কুক বা বাবুর্চিকে ২০০/৩০০ টাকা সম্মানী দিলে তারা অধিনায়কের কাছে বিভিন্ন কান কথা লাগিয়ে ইজ্জত মারা থেকে বাঁচাবে। আমি একবার আমার এক সিনিয়রের কাছে একটা দান করা শিখেছিলাম তা হল নাপিত, টেইলর, ধুপি, কুক, মেস-ওয়েটার, এনসিই ও রানার এদের দুই ঈদে উপহার প্রদান করলে এদের কারণে সৃষ্ট কিছু ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়। আমি তাই দুই ঈদে অফিসারদের নিকটে থাকা প্রাণীগুলোকে নিজ পকেট থেকে সাধ্যমত দান করি। কারণ এরা অনেক সময় অফিসারদের নিকটে থাকার কারণে অফিসারদের মাঝে বিরোধ বাধিয়ে দেয়।
আট মাস পরে বছরের শেষে এসিআর প্রাপ্তির সময় অবাক হলাম আমার র‍্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার অধিনায়ক আমাকে অসামান্যের কাছাকাছি নম্বর দিয়ে বসে আছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, এটা কেন? আমাকে বলল,আপনার প্রাপ্য আমি আপনাকে দিয়েছি। আমি মনে মনে বললাম,একজন অতিক্রান্ত অফিসারকে গড় ধরিয়ে দিয়ে সে বাহবা নিতে পারত। খামাখা নিজেকে বিতর্কিত করল।

উল্লেখিত অধিনায়ক যাওয়ার পর আরও দুজন সিনিয়র অধিনায়কের সাথে আরও ভাল চাকুরী করতে পারলাম। মনে হয় র‍্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার অধিনায়কের সাথে চাকুরী আমার সহনশীলতা ও ধৈর্য বাড়িয়েছে। তারপর দিনের শেষে ল্যাপটপ নিয়ে আমার কথাগুলো টাইপ করতে থাকলে সারা দিনের ক্লান্তি ও অপমান দূর হয়ে যায়। মনে হয় মাত্র কয়েকটা বছর পেরলেই হয়তবা এ জটিলতা থেকে মুক্তি। সেনাপ্রধান হওয়া ছাড়া অধিকাংশই কর্মকর্তাকেই কোন না কোন সময় র‍্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ারের সাথে চাকুরী করতে হয়। জিওসি হয়েও র‍্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার সিজিএস পেতে পারে। তবে মেজর র‍্যাংকের চ্যালেঞ্জটা জটিল ও ভয়াবহ। তবে জীবন থেমে থাকবে না। ছোটখাটো অপমান ও বিদ্রূপ গায়ে না মাখিয়ে আমাদের মত অতিক্রান্ত মেজরদের কাজ করে খেতে হবে। আমার মত অভিজ্ঞতা হয়ত অনেকের আছে তাদের সাথে অনুভূতি শেয়ার করাই আমার উদ্দেশ্য। জীবনকে নেতিবাচক না করে চ্যালেঞ্জিং করা প্রয়োজন এমন। কি বাইরে গিয়ে চাকুরী করেও শান্তি নাই। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলকে দেখলাম ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীর অর্ধশিক্ষিত মালিকদের সমীহ করতে করতে অবস্থা কাহিল। তাই সব শেষে বলতে হয়,” সুখ নাইরে পাগল আর সুখ পেতে হলে বাড়াতে হবে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা।