বিবাহিত জীবনের ১৮ বছর (২০১৫ সাল অবধি) বদলী বহুল জটিল
চাকুরী জীবনে সপরিবার থাকতে থাকতে ভয় পাই কবে পৃথক পরিবার হতে হয়। হয়তবা বড়
সন্তানের এইচএসসির পর ভাল কোন স্থানে ভর্তি হতে না পরলে সমস্যা শুরু হয়ে যাবে।
পৃথক পরিবার হওয়ার ঘণ্টা বেজে যাবে। দীর্ঘদিন পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে ও
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে চাকুরী করেছি। ঢাকায় কখনও চাকরীর সৌভাগ্য না হলেও ঢাকায়
চাকুরীর চিন্তা করছি না। একটা মাত্র ভয়ে আর তা হল সন্তানরা একবার রাজধানীর জীবনের
মজা পেলে রাজধানী ছেড়ে বের হতে চাইবে না। তখন পৃথক পরিবার কপালে জুটবে। চাকুরীর সাথে
সাথে বিভিন্ন স্থানে পরিবার নিয়ে থাকাটা হল বিশাল সেকরিফাইজ ও কষ্টকর একটা কাজ।
আমি হয়তবা পরিবারকে এক জায়গায় রেখে আমি অন্য স্থানে চাকুরী করলে বড় আনন্দে
কাটাতে পারতাম। একসাথে থাকলে ছোট শহরে অনেক কষ্ট হয়। সন্তানদের পড়াশোনার ক্ষতি
হয়। পাহাড়ে থাকতে সন্তানদের ম্যালেরিয়া হয়েছে। তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামে
সপরিবারে থেকেছি। আমার স্ত্রী জন্ম ও পড়াশোনা ইত্যাদির কারণে ঢাকায় কখনো বসবাস
করেনি। এর ফলে সে বরং ঢাকাকে ভয় পায়। আর এটা আমার জন্য একটি ভাল দিক । আমার ঢাকায় বাড়ী থাকলেও ট্রাফিক জ্যাম আর
খোলামেলা না থাকার কারণে আমি ঢাকা ভয় পাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের পৃথক
পরিবারের মূল কারণ ভবিষ্যতে রাজধানীতে সেটেলড হওয়ার ইচ্ছা। যেহেতু ভবিষ্যতে
রাজধানীতে সেটেলড হবে তাই সন্তানদের পড়াশোনার জন্য পূর্বেই ঢাকাতে স্থির হয়ে যাওয়া
ভাল। যুগ যুগ ধরে সন্তানদের পড়াশোনার জন্য
পিতামাতা নিজের জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের নিয়ে মা একদিকে আর বাবা অন্যদিকে
অবস্থান করছে। আমি তাদের সেকরিফাইজকে সাধুবাদ জানাই।
আমি একবার এক বন্ধুর সংস্পর্শে আসলাম। সে বন্ধু তার
প্রথম সন্তানের ৫/৬ বছর থেকে পৃথক পরিবারে চলে যেতে হয়েছে। কারণ সন্তান অনেক
মেধাবী হওয়ায় স্কলাসটিকার মত উন্নত প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েছিল। অথচ বিয়ের
পরবর্তী এই সময়গুলোতে আমরা অনেকেই স্ত্রী
ও পরিবার থেকে পৃথক হওয়া কল্পনা করতে পরিনি। সন্তানদের উন্নত পরিবেশে পড়াশোনা
করানোর জন্য এই ত্যাগকে স্যালুট করতে হয়। হয়ত স্কলাশটিকার মত উন্নত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা
করে সেই সব সন্তানরা দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে বা উন্নত দেশের উন্নত প্রতিষ্ঠানে
চাকুরী করে মধ্যবিত্ত বাবা মার মূর্খ উজ্জ্বল করবে।
আমার এই সুদীর্ঘ চাকুরী জীবনে যেহেতু গত ১৮ বছর বিভিন্ন
সেনানিবাসে ১৩ বার বাসা বদল করে চাকুরী করে এসেছি। সেহেতু আমার অনেক অনেক পরিবারের
সাথে জানাশোনা হয়েছে। পৃথক পরিবার হওয়ার যেসব কারণ চিন্হিত করা যায়:
১. স্বামী ও স্ত্রী দুইজন চাকুরীজীবী।
২. ঘন ঘন বদলী ও বাচ্চাদের স্কুল বদল।
৩. সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা।
৪. সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর কারণে ঢাকা ও
চট্টগ্রামের মধ্যে আবদ্ধ থাকা। তবে ইদানীং কিছু কিছু বিভাগীয় শহরে ইংলিশ মিডিয়াম
চালু হয়েছে।
৫. এছাড়াও উন্নত জীবন, অধিক পরিমাণ
বন্ধুবান্ধব প্রাপ্তি, সম্পদ রক্ষা, অসুস্থ
নিকট আত্মীয়, নিজ বাসস্থানে থেকে সরকারী বাড়ী ভাড়া সাশ্রয়
ইত্যাদি কারণে চাকুরীজীবীরা পৃথক পরিবার বেছে নেয়।
৬. স্ত্রী বা স্বামী বিদেশে থাকার কারণে।
৭. ছেলেমেয়ের পড়াশোনা শেষ বা ছেলে মেয়ে হোস্টেলে থাকে
তখন সপরিবারের সুযোগ থাকলেও দীর্ঘজীবন পৃথক পরিবার থাকতে থাকতে অনেকে পরে সপরিবারে
থাকার সুযোগ থাকার পরও পরিবারের সাথে বনিবনা হওয়ার সমস্যা মনে করে পুনরায় পৃথক
পরিবার থাকতে পছন্দ করে।
৮. পরিবারের সদস্যদের দুরারোগ্য ব্যাধি থাকায় রাজধানীর
বাইরে চিকিৎসা না পাওয়ার সম্ভাবনায় পৃথক পরিবার হয়।
উপরের কারণগুলো হল মূলত পৃথক পরিবার থাকার করন। এগুলো
সাধারণ সচ্ছল পরিবারের সমস্যা। অন্যদিকে অনেকের রাজধানী বা বড় শহরে স্বামী বা
স্ত্রীর পোস্টিং থাকলেও খরচ কমানোর জন্য ঢাকা বা বড় শহরে না থেকে ছোট শহরে বা
গ্রামে পরিবার রাখে। উপার্জন কম চাকুরীজীবীরা অর্থের কারণে রাজধানী বা বড় শহরে
পরিবার সাথে রাখতে ব্যর্থ হয়।
পৃথক
পরিবারের কারণ যাই হোক, আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, কেবলমাত্র আমার অদম্য ইচ্ছে ও স্ত্রী ঢাকা বেইজ না হওয়ার কারণে আমি ১৮ বছর
যাবত সপরিবার বিভিন্ন সেনানিবাসে থাকতে পেরেছি। আমার স্ত্রী ঢাকা বেইজ আর ঢাকায়
পড়ুয়া হলেই আমি পরিবার নিয়ে ঢাকার বাইরে পার্বত্য এলাকা আর মফ:স্বল শহরের সরকারী
কোয়াটারে থাকতে পারতাম না। আমার স্ত্রী কোন না কোন বাহানায় রাজধানীতে আস্তানা গেড়ে
বসত।
যারা সপরিবারে থাকে। বিশেষ করে আমার মত মধ্যম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অনেক বড় বড়
সেকরিফাইজ করতে হয়। প্রথমত: সন্তানদের গ্রামে গঞ্জের নিন্মমানের স্কুলে পড়াতে হয়।
সন্তানরা উন্নতমানের কোচিং থেকে বঞ্চিত হয়। উন্নতমানের উন্নত উচ্চারণের ইংরেজি
শিক্ষকের অভাব। নিন্মমানের সরকারী বাসস্থানে থাকতে হয়। ঢাকায় থাকলে হয়ত মন পছন্দ
নিজের বা আরো উন্নত ভাড়া ফ্লাটের বাড়ীতে থাকার সুযোগ হত। উন্নত ও মন পছন্দ
ফার্নিচার হতে বঞ্চিত হতে হয়। অর্জিত অর্থ খরচের সুযোগ কম হয়। সাধারণ মানুষের সাথে
মিশতে হয়। চাইলেই আনন্দ করার জন্য উন্নত পরিবেশ পাওয়া যায় না। এত সমস্যার পরও
কেবলমাত্র অতিরিক্ত পারিবারিক মায়ার কারণে আমার মত অনেকের পৃথক পরিবারে ভয় লাগে।
সপরিবারে গ্রামে গঞ্জে থাকাটা সত্যিই কষ্টকর। পৃথক পরিবারে রাজধানীতে থাকা যত
আনন্দের সপরিবারে চাকুরীর সাথে ঢাকার বাইরে থাকায় অত্যন্ত কষ্ট ও চরম স্বার্থ
ত্যাগ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে কারো নিউইয়র্কে থাকার সুযোগ থাকলে কেন সে আফ্রিকায়
থাকবে। তেমনি করো রাজধানীতে থাকার বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকলে সে মফ:স্বল শহরে থাকবে
না। কোন না কোন কারণ বের করে পৃথক পরিবার হয়ে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা রাজধানীতে
থাকবে। পৃথক পরিবার হওয়ার জন্য স্ত্রী ও সন্তানদেরই সাধারণত বেশী চাপ থাকে। কারণ
বড় পরিবেশ ও চাকচিক্যময় শহরে থাকতেই তারাই বেশী পছন্দ করবে ।
একবার আমার এক উপরের কর্মকর্তা একজনের আলোচনায় বললেন, একজন
কর্মকর্তা নিদ্দিষ্ট জেলায় বছরের পর বছর সপরিবারে কাটিয়ে দিচ্ছে। কোন পোস্টিং নাই।
বড়ই আনন্দে আছে । আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম। একজন ব্যক্তি স্ত্রীর চাকুরীর
সুবাদে ঢাকায় না গিয়ে ছোট শহরে চাকুরী করে সেকরিফাইজ করছে। এটাকে আমরা প্রশংসা
হিসাবেই দেখব। যদি সেই ব্যক্তি রাজধানীতে স্বামী স্ত্রী একসাথে চাকুরী করত ও
দীর্ঘদিন থাকত তবে হয়তবা তা আমরা বিশেষ সুবিধা হিসাবে মনে করতে পারতাম। মফ:স্বল
এলাকায় স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে বছরের পর বছর রাজধানীর দিকে ধাবিত না হয়ে সেকরিফাইজ
করছে। সেজন্য সে ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমার চাকুরীজীবনে একবার একজন উপরস্থ কর্মকর্তাকে পেলাম
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সপরিবারে দুই বছর ছিলেন এবং সন্তানদের উপজেলার স্কুলে
ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেই কর্মকর্তা অন্য এক জায়গায় পোস্টিং এসেছিলেন তিনমাস পর
ছেলের এইচএসসি পরীক্ষা। ছেলেকে বোর্ড চেঞ্জ করিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। তবু
সপরিবারে থাকলেন। আমি সারাজীবন সেই কর্মকর্তার প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সপরিবারে
বসবাস করার ধরনটি আমার পছন্দনীয় ছিল এবং আমি তা অনুসরণ করেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে।
কিছুদিন পর পর বাসা বদল এবং স্কুল বদল। ঘন ঘন বাসা বদলের জন্য একটা টেকনিক আমি
এ্যাপ্লাই করেছি। আর তা হল কোন ফার্নিচার তৈরি না করে সরকারী ফার্নিচারে চলা। যেমন
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী অনুমতি ক্রমে কম দামে ফার্নিচার বানানোর সুযোগ থাকলেও
সে সুযোগ বদলীর চাকুরীর জন্য কাজে লাগাইনি। তবে কষ্ট করে বাসা বদল করে ও স্কুল বদল
করে পরিবার সাথে সাথে রাখায় একটা লাভ হয়েছে
তা হল প্রতি সপ্তাহে উইক এন্ড বা অন্য ছুটি ছাটার দৌড়াদোড়ি থেকে মুক্ত
ছিলাম। এটাও একটা বিশাল বড় প্রাপ্তি। যদি একবছরের ৫০ টা উইক এন্ডে ছুটি যাই তবে
রাজধানীতে আসা যাওয়া সহ ৫০x১২ ঘণ্টা =৬০০ ঘণ্টা গাড়ীতে থাকতে হয়েছে, আর
এই ৬০০ ঘণ্টা চাকার উপর না থেকে বাসায় থাকলে কমপক্ষে ১০০ আর্টিক্যাল লেখা সম্ভব।
সপরিবারে থাকার কারণে ২৫ বছর চাকুরী শেষে সেদিন হিসাব মিলিয়ে দেখতে পাই ১৫ মাস
অর্জিত ছুটি বকেয়া রয়েছে।
পরিশেষে আর কথা না বাড়িয়ে আলোচনার ইতি টানছি। অবশ্যই
সপরিবারে থাকা পৃথক পরিবার থেকে ভাল। এতে ভালর দিকটাই বেশী। সপরিবারে থাকাটা
কিন্তু সহজ নয়। অনেক কষ্ট ও সেক্রিফাইজের বিষয় জড়িত। পৃথক পরিবারে থাকাটা অনেক সহজ
সমাধান। ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী আমরা সপরিবারে থাকার চেষ্টা করব সেটাই মঙ্গলজনক।