কাব্যের ছন্দে ও গানের সুর লহরীতে সারা বাংলাকে মাতিয়ে
দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। একজন ব্রিটিশ আর্মির সৈনিক কিভাবে ছন্দ নিয়ে মাতালেন
সেটাই অবাক করার বিষয়। একজন সৈনিক যুদ্ধের সময় অনেক ধরনের সমর প্রশিক্ষণের উপর
ভিত্তি করে মরিচা খনন, প্রতিরক্ষা তৈরি করে ও শত্রুকে আক্রমণের
প্রস্তুতি নেয়। শত্রুকে নাজেহাল করার নানা উপায় বের করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শান্তির
সময় তারা সকালে পিটি তারপর ট্রেনিং বিকালে গেইমস করে। রাতে রোল কল ও পরের দিনের কাজের
তালিকা জানানো ও ট্রেনিং বা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অতঃপর দশটায় লাইটস অফ। পুনরায়
ফজর নামাজের পর পিটিতে আসা। এভাবেই চলে কস্টকর সৈনিক জীবন। সৈনিক খাবে, প্রশিক্ষণ করবে, ক্লান্ত হবে ও আরাম করে ঘুমাবে।
এটাই সৈনিক জীবন। এর মধ্যে সাহিত্য আসে কোথা থেকে। লেফট রাইটের কাছে ছন্দ পালিয়ে
যাওয়ার কথা। কবি মানেই ঝকড়া চুল। উদাসী মানুষ। নরম মন। প্রেমময় চাহুনী। আলুথালু।
খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা নাই। এরূপ হবে নিবেদিত
প্রান কবি টাইপ মানুষগুলি। তবে হাবিলদার কিভাবে কবিতা লিখে। গান লিখে। এটা চিন্তায় আনাটা
সত্যিই বিস্ময়।
একজন হাবিলদার আজকের হিসাবে একজন নন কমিশন অফিসার। তিনি
সাধারণত দশ/বিশ জনের দল নিয়ে যুদ্ধ করেন। এটা সেকশন। ছোট দল। উপদল অনেক নাম আছে।
তিনি নেতা। আর সামরিক নেতাদের সাহিত্য শুরু হয় নিয়মিত কিছু কাজ করতে করতে।
প্রতিদিন নিজের জোয়ানদের সাথে সুখ দু:খের আলোচনা করতে হয়। ট্রেনিং ও যুদ্ধের জন্য
অনুপ্রাণিত করতে হয়। এখানে জোয়ানদের সামনে গুছানো বক্তব্য নিয়মিত দিতে হয়। তারপর
হল রিপোর্টিং। সিনিয়রকে লিখিত ও মৌখিক রিপোর্ট দিতে হয়। অপরেশনে বা ট্রেনিং শুরু
করার আগে জোয়ানদের ও বসদের মৌখিক বা লিখিত রিপোর্ট দিতে হয়। ট্রেনিং বা অপারেশন
শেষ করে পুনরায় মৌখিক ও লিখিত রিপোর্ট দিতে হয়। এভাবে বক্তৃতা ও লিখত ফরমে
লেখালেখির চর্চা চলতে থাকে। সৈনিকরা পরিবার থেকে দূরে ব্যারাকে থাকে বা যুদ্ধের
ময়দানে থাকে। তখন প্রিয়াকে বেশ
মনে পড়ে। দীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলে।
প্রিয়াকে নিয়ে বিরহী হয়ে যায়। মন চলে আসে কবিতার ছন্দে। এভাবে এগিয়ে যায় সেনা জীবন।
আমাদের হাবিলদার নজরুলের জীবন ব্যতিক্রম নয়।
একটা নিয়মিত চর্চার মধ্যে সেনা জীবনের সাহিত্য এগিয়ে
যায়। এই কারণে হাবিলদার হওয়ার পরও নজরুল কবিতা লিখেছেন।
আজকের নজরুলের অনুসারী সেনারা এর ব্যতিক্রম নয়। “কঠিন
প্রশিক্ষণ সহজ যুদ্ধ” এই মন্ত্রে যে রগড়া চলতে থাকে তাতে সাহিত্য আসাটা কষ্টকর
বিষয়। কিন্তু সাহিত্যের নানা চর্চা এগিয়ে নিয়ে যায় সেনাদের সাহিত্যিক হওয়ার
অনুপ্রেরণায়। আমি অত্যন্ত কাছ থেকে অবলোকন করে দেখেছি সকল সেনা কোন না কোন সাহিত্য
কর্মের সাথে কখনো না কখনো সম্পৃক্ত হয়। তা কখনো হতে পারে দেয়াল পত্রিকা, না
হয় প্রিয়াকে নিয়ে লেখা চিঠি ও কবিতা। নয়ত কোন স্মরণিকা বা সেনা ম্যাগাজিন।
বেসামরিক পরিমণ্ডলে হাবিলদার নজরুলের অনুসারীরা কতটুকু
স্থান পাচ্ছে বা মানুষ কতটুকু গ্রহণ করছে তা আমাদের কারো জানা নাই। তার উপর আমাদের
কোন সমীক্ষা নেই। সেনা লেখকের সংখ্যাটা এখনও কম নয়। সম্মুখ সময়ে যুদ্ধ করা অনেক সেনা
তার যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে গেছেন।
সেনা সাহিত্যিকদের সাহিত্য মূল্যায়ন করাটা ভয়ানক গোলমেলে
বিষয়। ধরুন আপনাকে একটা সম্মুখ সমরের যুদ্ধের বই দেয়া হল। এটা দেখে আপনার প্রথম
অনুভূতি হবে, আচ্ছা পড়ব। এটা
যুদ্ধের বনর্না আছে। কতটুকু আনন্দ পাব।
হয়তবা কতটুকু জানতে পারব। সাধারণ স্বনামধন্য সাহিত্যিক যেভাবে আনন্দ উদ্দীপক ভাবে
লিখেছে তেমনি ভাবে সেনাটা লিখতে পেরেছে কি? এই সব হিসাব নিকাশে অনেকে
সেনাদের বই হয়ত পড়ে না। হয়ত বা হাবিলদার নজরুল বিদ্রোহী কবি না হলে অনেক কবির ভিড়ে
হারিয়ে যেতেন। স্বাধীনতায় অনুপ্রাণিত করে মানুষের মনে স্থান নিয়েছেন। আজ সময় এসেছে
সেনা সাহিত্যকে সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার। সেনা সাহিত্য বাস্তবতার নিরিখে গ্রথিত। সমাজ ও মানুষের উত্তরণের আবেগে ও আহ্বানে আপ্লুত। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও
প্রচারণাই হয়ত হাবিলদার নজরুলের অনুসারী সেনা সাহিত্যিকদের দিতে পারে প্রতিভা
বিকাশের বিশাল অনুপ্রেরণা।