আমাদের কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে থাকে। তাদের এ উৎপাদন প্রায়শই ফলপ্রসূ হয়
না। ফসল উৎপাদনে তারা কম দাম পায়। অনেক সময় তাদের খরচই উঠে না। যদিও আজকাল কৃষকরা যাই উৎপাদন করুক তা মৌসুমের বাইরে সময়ে করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অবশ্য এতে কৃষকের ক্ষতি কমে আসে কারণ শীতে ফুলকপি বেশ বড়
আকারে পাওয়া যায়। একটা কেজি ওজনের ফুলকপি ১০/১৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। আবার গ্রীষ্মের অমৌসমে ২৫০ গ্রামের ছোট্ট ফুলকপি দাম ২০/৩০ টাকা হতে দেখা যায়। তাই দেখা যাচ্ছে অসময়ে কৃষক সব্জি উৎপাদন করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি সাপ্লাই চেইনে একটা সুষম বণ্টন করতে পারে। সারা বছর ফুলকপি চাষ করে বরং শীতকালে কম
পরিমাণে ফুলকপি চাষ করে শীতকালে সরবরাহ কমিয়ে ফুলকপির মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব।
কৃষক সারা বছর উৎপাদন করে সরবরাহ সুষম করে, প্রয়োজনের বেশী সরবরাহ হ্রাস করে, মূল্য স্থিতি রেখে, আমরা কৃষকের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি। তবে কৃষির সরবরাহ সুষম করলেও ফসলের সরবরাহ ও বাজারজাত প্রক্রিয়ায় অপচয় কমিয়ে আনতে পারলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই লাভবান হতে পারবে। প্রথম যে
বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল কোন অবস্থায় সব্জি পচতে দেয়া যাবে না। অতঃপর সব্জি বিষ মুক্ত প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে তিন/চার দিন পর্যন্ত বিক্রয় করলে সব্জি সতেজ রাখতে হবে। অবিক্রীত সব্জি পচনের ভাব হলে তা শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে অথবা ক্যান বা
এয়ার টাইট কনটেইনারে একবছরের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে। সব্জি কেটে ও প্রসেস করে হালকা সিদ্ধ করে জীবাণুমুক্ত করে ডিপ ফ্রিজিং করে সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা ব্যস্ততার জন্য প্রসেসজ সব্জি ক্রয় করে তাদের জন্য উপকারে আসবে। দেখা যাচ্ছে একটু উদ্যোগী হয়ে সকল পর্যায়ে ব্যবস্থা নিলে আমরা সব্জির উৎপাদন পরবর্তী সব্জির অপচয় শূন্য পর্যায়ে আনতে পারব। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ সুষম ও সম্পূর্ণ অপচয় রোধ হওয়ার কারণে ভাল লাভ করতে পারবে। সব্জি প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করে বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে। আমাদের দেশে ফসল তোলার মৌসুমে এমন অবস্থা হয়
যে, ফসলের মূল্য এত
কম থাকে লেবার খরচ দিয়ে ফসল তোলা লাভজনক থাকে না। তাই কৃষকের ফসল মাঠে প্যাকেট করে প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে পরিশ্রমী কৃষকরা তাদের আর্থিক বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।
ভোক্তা পর্যায়ে লাভ হবে। ভোক্তাকে আর অধিক দামে ক্রয় করতে হবে না। স্থিতিশীল মূল্যে সব্জি ক্রয় করতে পারবে। ব্যস্ত ভোক্তারা সহনীয় মূল্যে প্রসেসজ সব্জি ক্রয় করতে পারবে।
সব্জির পচন হতে বাঁচিয়ে কিভাবে আমরা প্রসেস করতে পারি তার উপর আলোচনা করা যাক। নীচে সব্জি জমি থেকে বাজারে পৌছা পর্যন্ত কার্যক্রমগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হল:
১. সব্জি জমি থেকে তোলার পর
তা পরিষ্কার করার প্রয়োজন পরে। অর্থাৎ জীবাণু নাশক পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করা। অর্থাৎ ব্লিচিং পাউডার যুক্ত পানি দ্বারা ধৌত করে নেয়া যেতে পারে।
২. সব্জির আকার আয়তন অনুযায়ী বাছাই করা। এটা প্যাকেট ও
মূল্য নির্ধারণের জন্য অত্যন্ত কাজে লাগবে।
৩. ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য একবারে ওজন করে ছোট ছোট প্যাকেট করা।
৪. ভোক্তার কাছে নিয়ে সব্জি ভ্যানের মধ্যে থরে থরে সাজায়ে নিতে হবে সরাসরি আনলোড করে বিক্রয় করা,এই প্রক্রিয়ায় একবার লোড ও
একবার আনলোড হচ্ছে। অন্যথায় জমি থেকে সব্জি লেবার দিয়ে বহন করে বাজারে নিয়ে তারপর পুনরায় বাজার থেকে বড়
ট্রাকে লোড। ট্রাক আবার পূর্ণ করে শহরে নিয়ে আনলোড। শহরে আনলোড করে পুনরায় খুচরা বিক্রেতাদের লোড ও
আনলোড। এ ধরনের লোড ও আনলোডে সময়, লেবার ও অর্থ সবকিছুই বেশী লাগে। এতে কৃষক পর্যায়ের সব্জির দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এটা এমন একটা ব্যবস্থা হবে একবারই লোড হবে এবং বাজারে বিক্রয়ের সময় একবারে আনলোড হবে।
৫. একবার সব্জি ভ্যানে সব্জি লোড হলে তা গ্রাহকদের কাছে বিক্রয় করার সময় ক্রমাগত আনলোড হবে এবং এটা হবে চলমান দোকান। ওজন করে প্যাকেট করা সব্জি সরাসরি বিক্রয় হতে থাকবে। প্যাকেটিং সামগ্রী হতে পারে পাটের ব্যাগ বা অন্য কোন কমদামী বিকল্প। পলিথিন ব্যবহার না করাই ভাল হবে। যদি পলিথিন ব্যবহার করা হয় তবে তা গ্রাহককে না
দিয়ে শীতাতপ ভ্যানে রেখে রি-ইউজ করা যেতে পারে।এমনও হতে পারে ভ্যানের রাখা প্যাকেট গ্রাহকের সব্জির ব্যাগে আনলোড করে পুনরায় সব্জির প্যাকেটগুলো ভ্যানের তাকে ব্যবহার করা যাবে।
৬. ভ্যানের তাপমাত্রায় সব্জি অন্তত সাতদিন রাখা যায় সেইভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ভ্যানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র সাধারণভাবে বাইরে হতে বিদ্যুৎ সংযোগে চলবে অন্যথায় চলমান অবস্থায় বা
বিদ্যুৎ বিহীন স্থানে জেনারেটরে চলবে।
৭. সব্জি যেন শুকিয়ে না যায় তার জন্য সব্জি ভ্যানের মধ্যে আর্দ্রতার মাত্রা কৃত্রিম উপায়ে ঠিক রাখতে হবে।
৮. সব্জি ধোয়া, বাছাই করা, ওজন করা ও
প্যাকেট করা ইত্যাদি সব্জি ভ্যানটি জমিতে নিয়ে অথবা গ্রামে নিয়ে করতে পারলে সহজে লেবার পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও গ্রামের অনেক নারী শ্রমিকও অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৯. সব্জির ভ্যানটি ফ্রিজার ভ্যানের মত
হলে ওর দাম অনেক বেড়ে যাবে। রক্ষণাবেক্ষণ
খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ইঞ্জিন ছাড়া টেনে নেয়ার মত (টোয়ড) ভ্যান হলে ভাল হবে। যে কোন জমিতে বা বাজারে যে
কোন গাড়ী দিয়ে টেনে নেয়া যাবে। যতদিন খুশি রাখা যাবে। জমি বা গ্রামের বাজারে লোডিং আনলোডের অনির্দিষ্ট সময় রাখা যাবে। আর লোড/আনলোড হয়ে গেলে পুনরায় যে
কোন গন্তব্যে যে কোন বাহনে (নসিমন ও কিরমন সহ) টেনে নেয়া যাবে। আবার বেশী বড় আকারে করা যাবে না কারণ লোডিং ও আনলোডিং এ বেশী সময় লাগবে। ১/২ টনের মধ্যে হলেই চলতে পারে। তবে বড় বড়
শহরে ভ্রমণকারী ভ্যান গুলো বড় হতে পারে।ছোট শহরের গুলো ছোট হবে।
১০. একটা ভ্যানে শাক সব্জি ফল
ইত্যাদি সবকিছুই থাকতে পারে যেন দ্রুত সবকিছুই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিক্রয় হয়ে যায়।
১১. সব্জি ৭/৮ দিন ভাল রাখার ব্যবস্থা থাকায় কম দামে বিক্রয় না করে ন্যায্য মূল্যে বেশী সময় অপেক্ষা করে কৃষক বিক্রয় করতে পারবে। একান্তই ন্যায্য মূল্য বিক্রয় করতে না
পারলে সব্জি হাফ বয়েল ফ্রিজিং বা শুকিয়ে প্রসেস করা ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এতে সব্জি পচে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
সব্জি ভ্যানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা গেল। এখন আসি এর এ্যাকসন প্লানে। রহিম মিয়া গ্রামের সচ্ছল কৃষক। তার গ্রামের আরো দশজন কৃষককে নিয়ে সে পাঁচ লক্ষ টাকায় দুইটি সব্জি ভ্যান তৈরি করল। ভ্যানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আছে ও
একটি ডিপ
ফ্রিজ আছে। একটি ভ্যান গ্রামে থাকে অন্যটি শহরের বাজারে থাকে। গ্রামে থাকা ভ্যানটি দশ কৃষকের পরিবারের সদস্যরা এক
হয়ে বিভিন্ন প্রকার সব্জি জীবাণুমুক্ত পানি দিয়ে ধুয়ে, বাছাই করে, ওজন করে ও
প্যাকেট করে। পরে বিভিন্ন রকম প্যাকেট সব্জিগুলো সব্জি ভ্যানে সাজিয়ে রাখে। ভ্যানের ডীপ ফ্রিজে কৃষকের উৎপাদিত দুধ, পুকুরের মাছ, প্রসেস করা মুরগী নিয়ে যাবে। এ ছাড়া অবিক্রীত সব্জি হাফ বয়েল করে ফ্রিজারে থাকবে। কৃষক তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব্জির ভ্যান সব্জিতে পূর্ণ হলে নসিমন, করিমন বা
ট্রাক্টর দিয়ে টেনে শহরের বাজারে চলে যাবে। শহরের বাজারে ইতিপূর্বে থাকা ভ্যানটির অবিক্রীত কিছু সামগ্রী নতুন সব্জি ভ্যানে রেখে খালি ভ্যান পুনরায় পূর্ণ করার জন্য গ্রামে ফেরত আসবে। আর যদি অবিক্রীত সব্জি বেশী পরিমাণে থাকে তবে তা পুনরায় গ্রামে ফেরত আসবে হাফ বয়েল করে ফ্রিজিং করার জন্য।
শহরের বাজারে সব্জি ভ্যান থেকে সব্জি,শাক, মৌসুমি ফল, ফ্রুজেন সব্জি, ফ্রুজেন দুধ ইত্যাদি বিক্রয়ের জন্য মজুদ থাকবে। কৃষকের প্রতিনিধি বিক্রয়ের জন্য শহরের বাজারে থাকবে অথবা বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়িত্ব নিবে।
আমার ধারনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব্জি ভ্যান পদ্ধতি চালু হলে ফসল কম নষ্ট হবে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে।এতে কৃষকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। সব্জি পচে অপচয় রোধ হওয়ার কারণে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে সর্বদা পরিচ্ছন্ন ও মান সম্পন্ন সামগ্রী পাবে। এ ধরনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব্জি ভ্যান এনজিওরা ক্ষুদ্র লোণের মাধ্যমে চালু করতে পারে। আবার ব্যবসায়ীরা কৃষকদের দৈনিক হিসাবে ভাড়ায় খাটাতে পারবে। আমার এ
ধারনাটি হয়তবা সময় ও সুযোগ পেলে আমি ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করতে পারব। এখনও যদি কেউ আমার এ
আইডিয়াটি বাস্তবায়ন করতে চায় তবে তাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া থাকল। “কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে” এটাই হোক আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ।