বাংলাদেশে যখন প্রথম ব্যাটারি চালিত রিক্সা চায়না থেকে
আমদানি করা হয় তখন একটা প্রচারণা আমার খুব মনে আছে। তা হল ব্যাটারি চালিত রিক্সা
পরিবেশ বান্ধব কারণ এটা ব্যাটারিতে চলে। পেট্রোল বা ডিজেল গাড়ীর মত কার্বন নি:সরন
করে বায়ু দূষণ করছে না। কিন্তু তখনও একটি প্রশ্ন ব্যাপকভাবে মাথা চড়া দেয়নি। যা আজ
অনেক অনেক বেশী মাথাচাড়া দিচ্ছে আর তা হল ব্যাটারি চার্জ করতে বিদ্যুতের প্রয়োজন
আর বিদ্যুৎ তৈরি করতে পুড়ানো হচ্ছে কয়লা, গ্যাস ও তৈল। তাই পরোক্ষভাবে আমরা রিক্সার ব্যাটারি চার্জ করতে ঠিকই
কার্বন দূষণ করছি। জ্বালানী সরাসরি জ্বালানো থেকে যদি বিদ্যুতে রূপান্তর করে তা
আবার ব্যাটারি চার্জিং করে সে ব্যাটারির শক্তি ব্যবহার করলে আরো বেশী জ্বালানীর
অপচয় হয়। ব্যাটারির চার্জিং সার্কিট তাপ উৎপাদন করে মূলত বেশ খানিকটা বিদ্যুতের
অপচয় করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে সস্তায় বিদ্যুৎ তৈরি সম্ভব হয়নি।
জলবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পারমানবিক
বিদ্যুৎ বা কয়লা থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারলে তবে তা রিক্সার ব্যাটারি
চার্জ করলে সাশ্রয় হত। এখন উন্নত দেশে ব্যাপকভাবে ইলেকট্রিক কার বা হাইব্রিড কার
তৈরি শুরু হয়েছে। এসব কার চার্জ করতে বিদ্যুতের প্রয়োজন। এ সমস্যার একটা ভাল
সমাধানে এগিয়ে এসেছে তারা। সকালে যখন বাসা থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ী নিয়ে অফিসে আসে তখন
গাড়ীতে তেমনই চার্জ বিদ্যমান থাকে যাতে নির্বিঘ্নে অফিসে যেতে পারে। অফিসে এসে
সবাই নিজ নিজ গাড়ীগুলো সোলার প্যানেলের তৈরি ছাতা টাইপ / ছাউনি সদৃশ শেডের নীচে
রাখে আর সেই শেডগুলো সোলার প্যানেলে তৈরি। সেই সব সোলার প্যানেল থেকে গাড়ীর
চার্জিং এর সংযোগ দিয়ে স্বীয় অফিসের কাজে মনোনিবেশ করে। অতঃপর ৬ঘন্টা অফিস শেষে
যখন বাসার পথে ফেরত আসার জন্য গাড়ীতে উঠে তখন গাড়ী থাকে সম্পূর্ণ চার্জড। যা কিনা
সারাদিনের কার্যক্রম শেষে পরের দিন অফিসে আসার মত চার্জ থেকে যায়। পরের দিন অফিসে
গিয়ে পুনরায় চার্জিং । এ ধরনের চার্জিং আর্বতে চলে বৈদ্যুতিক গাড়ীর ব্যবহার।
ব্যাটারি চালিত গাড়ী বা রিক্সা যদি তার ব্যাটারি যে কোন
নবায়ন যোগ্য বিদ্যুৎ উৎস থেকে চার্জ করতে
পারলেই আমরা সে সমস্ত বাহনগুলোকে সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব হিসাবে চিন্তিত করতে
পারি। বাংলাদেশে আমরা ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ে বেশ উৎবিঘ্ন কারণ এ ধরনের রিক্সা
আমাদের কয়েকটি সমস্যার জন্য দায়ী। প্রথমত আমাদের ভর্তুকি দেয়া বিদ্যুৎ এর ঘাটতি
সৃষ্টি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত আমাদের সীমিত
রাস্তার প্রতিনিয়ত ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করছে।
মজার বিষয় হল, শহরে চলমান কিছু ব্যাটারি চালিত রিক্সা বা বোরাক প্রথম যখন আমদানি করা
হয় তখন রিক্সার মতন পৌরসভা থেকে লাইসেন্স দেয়া হত। পরবর্তীতে যখন সরকার টের পেল এ
ধরনের রিক্সা বিদ্যুতের বারোটা বাজাচ্ছে তখন সরকারের তরফ থেকে অনুমতি দেয়া বন্ধ
করে দেয়। কিন্তু তাতে কোণ লাভ হয়নি। বরং পৌরসভা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভুয়া
কাগজ তৈরি করে বিভিন্ন দালাল ও দূনীতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গকে ম্যানেজ করে দিনকে দিন
বোরাক রাস্তায় গিজ গিজ করছে। সস্তা বাহন হিসাবে সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয়। আমরা যারা
সরকারী কর্মকর্তা ছুটিতে যখন সরকারী বাহন মুক্ত থাকি অথবা আর্থিক বিবেচনায়
ব্যক্তিগত বাহন ব্যবহার হতে সাময়িক বিরতি দেই তাদেরও মাঝে মাঝে এসব বাহনে সপরিবারে
উঠতে হয়। তখন মন্দ লাগে না। বিশেষ করে আমার তিন সন্তান, কাজের
লোক, স্ত্রী সমেত আমার এ ধরনের বাহনে দুই রিক্সার বদলে
একটি বোরাকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারি।
আমাদের দেশের সরকার এ ধরনের বাহনগুলি বিদ্যুৎ সমস্যার
জন্য তুলে দিতে চায়। তাই লাইসেন্স প্রদান বন্ধ নবায়ন বন্ধ। এতে কি তেমন লাভ হচ্ছে:
মোটেই না। বোরাক তো বন্ধ হচ্ছে না বরং এখন সাধারণ
রিক্সায়ও ব্যাটারি আর মটর হরদম ব্যবহার হচ্ছে। আমার মনে হয় আর পাঁচ বছর পর কায়িক
ভাবে টানা আর রিক্সার দেখা মিলবে না। এই যদি হয় ভবিষ্যৎ তবে দেরী না করে দ্রুত
ব্যাটারি রিক্সার আরএন্ডডি করে সেফটি ফ্যাক্টর নিশ্চিত করে লাইসেন্স প্রদান করা
অতি প্রয়োজন। লাইসেন্সের শর্ত হিসাবে থাকবে এ ধরনের রিক্সায় সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ
থেকে চার্জ না করে সৌরশক্তি বা নিজ ব্যবস্থাপনায় জেনারেটর থেকে চার্জ করার
ব্যবস্থা করতে হবে।
আমার ছোটবেলায় যখন মিশুক চালু হয় মনে আছে সে সময়
প্রত্রিয়ায় পড়ে ছিলাম। রিক্সা মানব সভ্যতার অত্যন্ত বর্বরতম দিক। মানুষ মানুষকে
কায়িক পরিশ্রমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তখন মিশুকের মত ছোট ইঞ্জিনের গাড়ীগুলো বেশ
খানিকটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কায়িক পরিশ্রমে চালিত জ্বালানী বিহীন পরিবেশ বান্ধব
রিক্সা মিশুক দ্বারা প্রতিস্থাপনের পায়তারা চলছিল। কিন্তু পেট্রোলের ক্রমাগত
ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যের ভাড়ার কারণে মিশুক গাড়ী তেমন বিস্তৃতি লাভ করেনি। যার
স্থানটি পরবর্তীতে সিএনজি ট্যাক্সি দখল করে নেয় ।
এখন বোরাক গাড়ী বা সাধারণ রিক্সায় মটর লাগানো বাহন বন্ধ
করার পদক্ষেপ অনেকটা বাস্তবতা বিবর্জিত পদক্ষেপ। আবার লাইসেন্স নবায়ন বা নতুন
লাইসেন্স না দিয়ে দালাল ও অন্যান্য অনেককে অবৈধ আয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
আমাদের সকলের উচিত ব্যাটারি চালিত রিক্সাকে বিদ্যুৎ আর
রাস্তার সংকটের জন্য তুলে না দিয়ে বরং এর পিছনে আরএন্ডডি করা। আর আরএন্ডডির টাকা
কিন্তু সরকারের নিজের দেয়ার প্রয়োজন হবে না। রিক্সার চালকরাই দিবে। সরকারের
প্রয়োজন এদেরকে দালাল মুক্ত করে লাইসেন্স ফি বাবদ মোটা অংকের টাকা আদায় করা। দেশে
যদি একলক্ষ ব্যাটারি চালিত রিক্সা থাকে এবং সরকার যদি প্রতি রিক্সা থেকে প্রতি বছর
৫০০০ টাকা করে আদায় করে তবে এক লক্ষ রিক্সা থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায় হবে আর ৫০ কোটি
টাকা দিয়ে ১ কোটি ওয়াট বা ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এভাবে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে
সরকার ঠিকই ব্যাটারি চালিত রিক্সার বাড়তি বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে উৎপাদন করে ফেলতে
পারত। তখন বিদ্যুৎ নিয়ে এদের পিছে না লাগলেও চলত।
ব্যাটারির রিক্সা চালকদের বাহন বন্ধ না করে এদের টাকা
দিয়ে সরকার তাদের জন্য পরিবেশ বান্ধব সৌর বিদ্যুৎ তৈরি করে ফেলতে পারত। বেশ দেরীতে
হলেও সরকার ব্যাটারি রিক্সার চাজিং পয়েন্ট পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে বিভিন্ন সিটি
কর্পোরেশনে তৈরি করার চেষ্টা করছে। এটা একটা ভাল উদ্যোগ সন্দেহ নাই। কিন্তু
ব্যাটারি রিক্সাদের চার্জের জন্য পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কারণ দিনে চার্জ দিলে
এরা রোজগার করবে কখন? তবে যদি এদের
ব্যাটারি দ্রুত বদল করার সিস্টেম করা যায় তবে হয়ত দিনের বেলা চার্জিং জনপ্রিয় হবে।
অন্যথায় এদের লাইসেন্স ফি বাবদ অধিক টাকা নিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ তৈরিতে ব্যবহারই হবে
সহজ পন্থা।
আমি কুষ্টিয়ার ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানিতে
দেখলাম তারা ফর্ক লিফটার চালানোর জন্য বড় বড় রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যাবহার করে। এ
সকল ব্যাটারি আলাদা চার্জ করে প্রয়োজন অনুযায়ী ফর্ক লিফটারে লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের রিচার্জেবল ব্যাটারি
কিন্তু রিক্সার জন্য তৈরি করা যায়। যা আলাদাভাবে থাকবে। আলাদাভাবে চার্জ দেয়া হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী
রিক্সাতে ব্যবহার করা যাবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ডিসচার্জ ব্যাটারি যখন তখন ব্যবহার
করা যাবে। ব্যাটারি রিক্সা সোলার চার্জিং পয়েন্টে এসে তার ব্যাটারি বদলিয়ে নিবে।
এভাবে সোলার চার্জিং পয়েন্ট ব্যবহার বাস্তব সম্মত হবে। জাপান সম্প্রতি ডুয়েল
কার্বন ব্যাটারি আবিষ্কার করেছে যা কিনা কমদামী। ওজন কম ও দ্রুত চার্জ হয়। এ
ব্যাটারিগুলো ২০ মিনিটে চার্জ সম্ভব। তবে ব্যাটারি রিক্সার ক্ষেত্রে বিশ মিনিট নয়
১ বা ২ ঘণ্টায় চার্জ হলেও তা সাশ্রয়ী হবে। কারণ দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে ব্যাটারির
রিক্সা চালকরা তাদের রিক্সার ব্যাটারি নির্দিষ্ট সোলার পয়েন্ট থেকে চার্জ করতে
পারবে।
আমি
বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে আশা করি আপনাদের বুঝাতে পেরেছি ব্যাটারি চালিত রিক্সা
বন্ধ করার মত জ্বালা-হুয়া উদ্যোগ না নিয়ে বরং রিক্সা চালকের কাছ থেকে বেশী বেশী
রাজস্ব আদায় করে বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন করুন, রাস্তা প্রশস্ত করুন এবং ব্যাটারির বাহনের উন্নয়নে বেশী বেশী করে
আরএন্ডডি করুন। আর এ ধরনের ব্যাটারির রিক্সা তুলতে পারলে লাভবান হবে আমাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী
ভারত কারণ তারা বেশী বেশী করে সিএনজি ট্যাক্সি রপ্তানি করে আমাদের দেশ ভরিয়ে দিবে।
বর্তমানে
ব্যাটারি রিক্সায় উন্নত প্রযুক্তির ব্রাশ লেছ (বিএলডিসি) মটর ব্যবহার করে। এ মটর
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লো মেইন্টেণ্যান্স ও দীর্ঘস্থায়ী। এসব মটর চায়না
এবং ভারতের তৈরি। প্রতিটি মটরে সিরিয়াল নম্বর আছে। মটরের এই সিরিয়াল নম্বর
দিয়েও ব্যাটারি রিক্সার লাইসেন্স দেয়া সম্ভব। তাই সরকারের অতি দ্রুত ব্যাটারি
রিক্সা লাইসেন্স এর কার্যক্রমে নিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করে ব্যাটারির রিক্সা পরিবেশ
বান্ধব করা, আরএন্ডডি করে নিরাপত্তা
বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করলে অবশ্যই আমাদের ব্যাটারি চালিত
রিক্সা আপদ না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।