একটা মানুষ মনের
আনন্দে তার ভাল লাগার কাজটি করে যাচ্ছে। নিজের সময় ও টাকা খরচ করে। কে তাকে নিয়ে
হাসল ও কৌতুক করল তা নিয়ে তার কোন বিকার নেই। সহজ সরল একটি মানুষ বগুড়ার ডিশ আলম
বা হিরো আলম। আমি ৫ ডিসেম্বর ২০১৬ হতে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ভারতে একটি ট্রেনিং করা
সময় আমাদের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন ভারতীয় হিন্দি ভাষী কর্মকর্তার কাছে প্রথম জানতে
পারি বাংলাদেশের হিরো আলম সম্পর্কে। ভারতে থাকাকালীন ইন্টারনেটে হিরো আলম সার্চ
দিয়ে অনেক তথ্য পাই। তার এই প্রচার ও পরিচিতির ধরনটা যেকোনো মানুষের জন্য অনুকরণীয়
হতে পারে। কে কি বলল, না বলল, পছন্দের ভাল কাজ
লজ্জায় ছেড়ে না দিয়ে করে যেতে থাকলে এবং ক্রমাগত উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যেতে
থাকলে উন্নতি আসবে সন্দেহ নেই। এ কারণে হিরো আলম হতে পারে অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার
উৎস।
অনেকদিন আগে আমি
প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটি সাক্ষাতকার শুনেছিলাম। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল
আপনি রসায়নের অধ্যাপক হয়ে লেখালেখিতে কেন আসলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি
লিখে আনন্দ পান। তিনি মনের আনন্দের জন্য লিখতেন। হুমায়ুন আহমেদ নিজের লেখা কতটুকু
কাউকে আকর্ষণ করল কিনা বা কেউ আহত হল কিনা। বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবসা সফল হল কিনা বা
বাজারে চলবে কিনা ইত্যাদি চিন্তা করে লিখতেন না। মনের আনন্দের জন্য কষ্ট করে রাতের
পর রাত লিখে যেতেন। দিনের পর দিন লেখা সম্পাদনা ও সংশোধন করে যেতেন। আর এসব কাজ
ভাল না লাগলে বা ভাল না বাসলে করা সম্ভব নয়। অনেক ধৈর্য ও কষ্টকর কাজ। আমি ক্যাডেট
কলেজের সপ্তম শ্রেণী থেকেই পত্রিকা প্রকাশনা ও লেখালেখি করে আনন্দ পাই। একাদশ
শ্রেণীতে নিজের স্টাইফেনের টাকা খরচ করে ফটোকপি করে “চন্দ্রদ্বীপের
চিঠি” নামে পত্রিকা বানাই। বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করেছিল, আমার
বেকুব টাইপ কাজ দেখে। এইতো তিনবছর আগে আমাকে একজন বলেছিল, আপনি যে
লেখালেখি করেন তার ভবিষ্যৎ কি? এত লেখক থাকতে আপনি ভাত পাবেন। তার
চেয়ে অন্য কাম করেন। উন্নতি করবেন। টাকা পয়সার রোজগার বাড়বে। আমার উত্তর ছিল,
আমি আনন্দের জন্য করি। এটা থেকে আয় হবে, কেউ লেখাটা পড়বে
কিনা এ চিন্তায় লিখি না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি গত পাঁচ বছরে দেড় শতাধিক লেখা
লিখেছি। গত দুইবছর থেকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ভাবে একটি করে লেখা লিখি। তবে
বেশীরভাগ বন্ধুবান্ধব আমাকে উৎসাহ দিয়েছে দুই একজন হিরো আলমের মত হাসাহাসি করেছে।
আমি ভারত থেকে
ফিরে হিরো আলম নিয়ে ইন্টারনেট গবেষণা শুরু করলাম। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার এরুলিয়া
গ্রামের হিরো আলম জানে তার চেহারা নায়কের নয় অথচ তার ভাল লাগে অভিনয় করতে। সেজন্য
কি তার মনের আশা অপূর্ণ থাকবে। মোটেই না। সে নিজের টাকায় নিজের ব্যবস্থাপনায়
মিউজিক ভিডিও তৈরি করেছে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়। সে মিউজিক ভিডিও প্রচার করেছে
তারই ক্যাবল টিভির চ্যানেলে। তার এলাকার নবম, দশম ও কলেজ
পড়ুয়া মেয়েদের নিয়েছে মডেল হিসাবে। ছোটবেলায় অনেক মেয়ের মডেল হওয়ার স্বপ্ন থাকে
কিন্তু পারিবারিক, আর্থিক, লাবন্যতা ও
সক্ষমতার কারণে যাদের মডেল হওয়া সম্ভব নয় তারা যোগ দিয়েছে হিরো আলমের কাতারে।
গ্রামের অদক্ষ ও আগ্রহী মেয়েগুলোর নেই কোন বাণিজ্যিক চিন্তা। নেই কোন বিখ্যাত
হওয়ার ভাবনা। তাদেরও অভিনয়ের স্বপ্ন পূরণই হল সার্থকতা। তাই মেয়েগুলোর বিপরীতে
সাধারণ চেহারা একজন ছেলে মডেল নিয়ে তাদেরও মাথাব্যথা নেই। তাদের অভিনয়গুলো
কৃত্রিমতা বির্বর্জিত ও অনেক অনেক বেশী অনুশীলন ও আন্তরিকতা নিয়ে করা। যার ফলে
মডেলদের চেহারা যাই হোক অকৃত্রিম অভিনয়ের জন্য তারা আধুনিক জেনারেশনের যুবক
যুবাদের মোবাইলে লক্ষ লক্ষ বার দেখা হচ্ছে। মাত্র সাত মাসে(জুন-ডিসেম্বর ২০১৬)
হিরো আলমের “রূপের মাইয়া” মিউজিক ভিডিওটির
দেখা হয়েছে ১২ লক্ষেরও বেশী। এছাড়া ডিসেম্বর ২০১৬ এসে জানা যায় গুগলের সার্চে নায়কদের
মধ্যে সবোর্চ্চ সালমান খানকে সে পিছে ফেলেছে। উইকিপিডিয়ায়ও তাকে নিয়ে পেইজ খোলা
হয়ে গেছে।
হিরো আলম
অত্যন্ত সাধারণ মানুষ যে নিজের শখ মিটাতে সৃষ্টিশীল কাজ করেছে। সে আট বছর যাবত করে
যাচ্ছে। তার চরিত্রের শক্তিশালী দিক হল হাসি ও বিদ্রূপের মধ্যে নিজের আনন্দের জন্য
কাজ করে যাওয়া। কম খরচে এলাকার ছেলে মেয়েদের বান্দরবন ও কক্সবাজার বেড়ানোর মত
স্বপ্ন পূরণের আয়োজন করা তার আর একটি মহত কাজ। সে এলাকায় মেম্বার পদে নির্বাচনে
দাঁড়িয়েছিল। সত্তর ভোটে হেরেছে। সে আরো দাড়াতে চায় কারণ সে র্নিদমনীয়।সে বলেছে যে
কোন চেহারার ছেলে মেয়ে যেই অভিনয় করতে আগ্রহী তাকে নিয়েই সে ভিডিও বানাবে। তাদের
স্বপ্ন সে তার টাকায় পূরণ করে দিবে। কোন ব্যবসা নেই। হয়তবা তার এই উদ্যোগের কারণে “বিল
কসবী” বা “উইফ্রে অপেরান্হ” মত সাধারণ
চেহারার বাংলাদেশের গ্রামের অনেক মডেল বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে। তার আর একটি ইচ্ছে হল
অনাথ আশ্রম দেয়া। এতে তার নিঃস্বার্থতা ও মহত্ত্বের প্রকাশ পায়।
পরিশেষে বলব
আমাদের অনেকের অনেক স্বপ্ন থাকে। সেগুলো পূরণে আমরা ব্যর্থ হই। আশে পাশের লোকেরা
উপহাস করে। সে রকম ব্যর্থদের জন্য হিরো আলম অনুপ্রেরণা। প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন
আহমেদ নিজের আনন্দের জন্য লিখতেন। তেমনি আমাদের পছন্দের কাজটি নিজের আনন্দের জন্য
করাটাই আত্মতৃপ্তি। মনের ও আত্মার শান্তি বড় শান্তি। সফলতা ও বিখ্যাত হওয়াটা পরের
বিষয়। তবে একটা কথা আছে, “যদি লক্ষ থাকে অটুট বিশ্বাস হৃদয়ে,
হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে”।