সামরিক বাহিনীর সিনিয়র ও জুনিয়ার মর্যাদা ও সম্মানের লড়াইটা
অনেক অনেক বেশী দৃঢ় ও কঠিন। তাই মিলিটারি একাডেমীতে যে জুনিয়ারকে
রগড়া দিল আজ যখন সে বস তা ভয়ানক পীড়াদায়ক। আবার চাকুরীর মেয়াদ পূর্তির পূর্বে চাকুরী
ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজন ইমোশনাল হওয়া ও বাইরে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য ভিত্তি।
২০০৭ সালে কঠিন এক বসের কাছে মন্দ ব্যবহার পেয়ে সিদ্ধান্ত
নিলাম আসন্ন দ্বিতীয় মিশন শেষ করে চাকুরী ছেড়ে দিব। কম্পিউটারের দোকান দিব। অনলাইন পত্রিকা চালাব। লেখালেখি করব। কম খরচে চলার জন্য বগুড়ায়
থাকব(১০,০০০ টাকায়
মান সম্পন্ন ডি টাইপ বাসা পাওয়া যায়) পেনসনের টাকা ব্যাংকে
রেখে লাভ নিব। ঢাকা, কুমিল্লার পৈত্তিক বাড়ীর ভাড়া, জমির আয় ও বগুড়ার
স্ত্রীর জমির বাড়ীর আয়। এছাড়া এএইচএস পেলে তার কিছু ফ্লাট বিক্রি
ও ভাড়ায় খাটানো যাবে। সমস্ত আয় যোগ করে নিলে চালক সহ পুরাতন
কার, বাসায় দুটি এসি(সোলার পাওয়ারে চালানো যেতে পারে) ও বাচ্চাদের বগুড়ার
ক্যান্টনমেন্টে ইংরেজি ভার্সনে পড়ানো যাবে। চিকিৎসা সহায়তা হয়ত
বগুড়া সিএমএইচে নেয়া যাবে। বেশী ক্রিটিক্যাল হলে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে
ঢাকা নেয়া যাবে।
বেশ সুন্দরভাবে পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। লোভে পরে শেয়ার মার্কেটে
ঢুকলাম তারপর থেকে আমার বিপদ শুরু শেয়ারে ধস। ব্যাংকে পেনশনের বিপরীতে
অগ্রিম লোণ। সব কিছু থেকে রেহাই পেলাম দ্বিতীয় মিশনের
টাকা শেষ করে। যা ঘটল কোমর ভেঙ্গে গেল। চাকুরী ছাড়ার চিন্তা
সাময়িকভাবে বাদ দিতে হল।
মিশন থেকে এসে প্রথম হয়রানী হল জুনিয়ার কোর্সের কর্মকর্তাকে
অধিনায়ক হিসাবে পাওয়া। নিজেকে প্রবোধ দিলাম চাকুরী ছেড়ে দেয়া
পর্যন্ত জুনিয়ারের পেঁদানি খেতেই হবে। আমরা চাকুরীতে যেটা মেনে নিতে পারি। সামাজিক ভাবে বসবাসরত
আমদের পরিবারের জন্য তা কষ্টকর। তারপর কুরআনের বানী,আল্লাহ যাকে ইচ্ছে রাজত্ব দিতে পারেন, যখন খুশী কেড়ে নিতে পারেন” একজন লে: কর্নেল যে কিনা সেনাপ্রধানও হতে পারত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস
তাকে হাজতবাস করতে হচ্ছে।
আমার এক কোর্স-মেট
সেও বিজিবিতে পোস্টিং পাওয়ার পর তার স্ত্রী আমার স্ত্রীকে বলল, “বিজিবিতে একটাই সমস্যা ঘন ঘন পোস্টিং আর জুনিয়ারের অধীনে চাকুরী করতে হয়। আর জুনিয়ারের স্ত্রীকে
রিসিভ করার জন্য ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকা আরও কষ্টকর”
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম সমস্যাটা মানসিক তাই এর চিকিৎসাটাও
মানুষিক-ভাবে করতে হবে। প্রথমত: তুমি যদি মনে কর,স্বামী থেকে র্যাংকে
সিনিয়র আর চাকুরীতে জুনিয়ার কাউকে রিসিভ করতে ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছ তাহলে মনস্তাত্ত্বিক
সমস্যা বাধবে। যদি মনে কর,সম্মানিত ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে যত্নের সাথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছ
আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে, তবে এ কষ্টটা আর পাবে না। কারন সরকারী প্রতিষ্ঠানে ঝাড়ুদার থেকে
অধিনায়ক সকলেরই কম বেশী গুরুত্বপূর্ণ অধিকার আছে। সেখানে নিজেকে তুচ্ছ
ভাবার কারণ নেই। আর অফিসারদের আমরা ব্রাদার অফিসার মনে
করি।
সে যাক গে, আমার স্ত্রীর অবশ্য ফুল হাতে দাড়িয়ে থাকতে হয়নি বা অন্য কোন অনাচারে পড়তে
হয়নি।
পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে র্যাংকে সিনিয়র বসের সাথে চাকুরী
করা সহজ বলব না। এটা আসলেই চ্যালেঞ্জিং বিষয় যেটা হয় এতে প্রয়োজন
ভয়ানক রকম ইমোশন নিয়ন্ত্রণ। কঙ্গো মিশনে( ২০১১-১২) কন্টিনজেন্টের টুআইসি ও অপারেশন অফিসারের দুইজন যারা পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে
র্যাংকে লে: কর্নেল তাদের সাথে ক্রিটিক্যাল চাকুরী করার কারণে
জুনিয়ার বস নিয়ে চাকুরী বিষয়ে ভাবনার মধ্যে পরিনি।
পোস্টিং হওয়ার পর আমি পূর্বের জুনিয়ার বর্তমানে র্যাংকে
সিনিয়র অধিনায়ককে ফোন দিলাম।অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে প্রথম প্রশ্ন, আপনি কি সপরিবারে আসছেন। আমি হ্যাঁ সূচক বলায়
খুবই খুশি হয়ে বলল,” আমার স্ত্রী ও সন্তানরা
একাকী আছে। পরিবারের সংখ্যা বাড়লে তাদের খুশী। আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
জয়েন করার পূর্বে আমি ইন্ট অফিসারের সাথে বাসার বিষয় নিয়ে
যোগাযোগ করলাম। ইন্ট অফিসার আমাকে যা বলল তাতে আমি একটু
অবাকই হলাম। সে জানাল, অধিনায়ক ব্যারাক এনসিও, এসএম ও
ইন্ট অফিসারকে নিয়ে আমার জন্য বরাদ্দকৃত কোয়ার্টারে কি কি কাজ করতে হবে তা দেখিয়েছেন
এবং বাসার অনেক উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছেএ বিষয়টিতে মনে হয়েছে
অধিনায়ক বেশ কেয়ারিং। অধিনায়ক তার অধস্তন কর্মকর্তার বাসার
উন্নয়নের জন্য চিন্তা করবেন বাঙ্গালী মানসিকতায় এটা ভাবাই যায় না।
ইউনিটে আসার পর ইন্ট অফিসার উপস্থিত হয়ে স্বাগত জানাল এতে
সত্যি মনটা বেশ ভাল হল। অফিসের প্রথম সাক্ষাতে অধিনায়ক বলল, প্রাতিষ্ঠানিক কারণে আপনি সিনিয়র হয়েও আমার টুআইসি। আপনার কাছ থেকে আমি
যথাযথ সহযোগিতা আশা করছি। আমি তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কাজ শুরু
করলাম। ২২ বছর চাকুরীতে এসে আমি ৩০০ রিক্রুটদের ওআইসি হলাম। এতে একটা বিষয় হল, আমাকে নিয়মিত পিটিতে যেতে হত ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকছিল। আর একজন মেজর থাকায়
কাজের চাপ ভাগ হচ্ছিল। বিপত্তিটা তখন বাধল যখন ইন্ট অফিসারের
বদলী হল। এমনকি কোন এডি(ডিপার্টমেন্টাল অফিসার) নাই। রিক্রুট ওআইসি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিক্রুটদের সমস্ত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ,
টুআইসির দায়িত্ব, আপস অফিসারের দায়িত্ব,
সোর্স হ্যান্ডেলিং ও প্রায়শই রাতে অপারেশন। জীবন মোটামুটি ত্রাহি
ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যে অধিনায়কের আদেশ, কোন গাড়ী পাঠাতে হলে তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনে কমপক্ষে ২০/৩০ বার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে হয়। মাঝে মাঝে ফোনে অধিনায়ককে
না পাওয়া গেলে এসএমএস দিতে হত।
সামরিক ইউনিটের এ্যাডজুট্যান্টকে এত চাপ সহ্য করতে হয় না
যা বৃদ্ধ বয়সে বিজিবি,র মেজরকে করতে হয়।
জুনিয়ার অধিনায়কের সাথে আমাকে জানুয়ারি ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০১৩
আট মাস চাকুরী করতে হয়েছে। এর মধ্যে দুইবার ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। তখন আমাকে বিনয়ের সাথে
বলতে হয়েছিল, আমাকে দিয়ে যদি ইউনিট চালাতে সমস্যা
হয় অনুগ্রহ করে যে কোন ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করতে পারেন” এগুলো
বলার কারণ আমার চাকুরীর রেকর্ডে কোন শাস্তি নেই। আর প্রমোশন অতিক্রান্ত
হয়ে এখন শাস্তি পেলে কি ক্ষতি হবে তা আমার জানা নেই। আর আমাকে যদি ফোর্স
রিটায়ার করতে হয় তবে তা মন্দ নয়। কারণ চাকুরী নিজে থেকে ছাড়ার পথে পরিবার
প্রধান অন্তরায়। যদি কেউ জোর করে অব্যাহতি দেয় তবে তা
হয়ত ভাল হবে। পরিবারের কাছে আর দায় থাকবে না।
আমার স্ত্রী সাথে জুনিয়ার অধিনায়কের স্ত্রীর কখনও মনঃকষ্টের
বিষয় ঘটেনি। কারণ আমার স্ত্রী ভাল শ্রোতা হওয়ায় কখনও
সমস্যায় সে পড়েনি। উচ্চতর র্যাংকের অফিসারের পত্নীরা স্বাভাবিকভাবেই
সফলতার গল্প করতে পছন্দ করেন। আর আমার স্ত্রী বেশ চুপচাপ তা শোনার অভ্যাস
করে ফেলেছে।
চাকুরীতে জুনিয়ার ও র্যাংকে সিনিয়র অধিনায়কের সাথে চাকুরীর
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিরোধ হতে পারে। গাড়ী নিয়ে বিরোধ। নিজের কারটি প্রস্তুত
রাখলে সমস্যা কম হবে। অফিস ও বাসায় খবরের কাগজ,টিস্যু পেপার ইত্যাদি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু নিজ খরচে
চললে ভাল থাকা যাবে। ইউনিটের সব্জি বাগান, ফল ফলাদি ও পুকুরের মাছ ইত্যাদি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলে
বিরোধ কম হবে। এগুলো সমস্ত কিছু মিলিয়ে এক থেকে দুই
হাজার টাকার বেশী লাভ নাই কিন্তু ইজ্জত যেতে পারে ও খামাখা ঝামেলা বাড়তে পারে। মেস-ওয়েটার ও কুক বিনা পারিশ্রমিকে খাটানো মেজর র্যাংকে ঠিক
নয়। ব্যক্তিগত পার্টির বা কাজের শেষে কুক
বা বাবুর্চিকে ২০০/৩০০ টাকা সম্মানী দিলে
তারা অধিনায়কের কাছে বিভিন্ন কান কথা লাগিয়ে ইজ্জত মারা থেকে বাঁচাবে। আমি একবার আমার এক সিনিয়রের
কাছে একটা দান করা শিখেছিলাম তা হল নাপিত, টেইলর, ধুপি, কুক,
মেস-ওয়েটার, এনসিই
ও রানার এদের দুই ঈদে উপহার প্রদান করলে এদের কারণে সৃষ্ট কিছু ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা
যায়। আমি তাই দুই ঈদে অফিসারদের নিকটে থাকা
প্রাণীগুলোকে নিজ পকেট থেকে সাধ্যমত দান করি। কারণ এরা অনেক সময় অফিসারদের
নিকটে থাকার কারণে অফিসারদের মাঝে বিরোধ বাধিয়ে দেয়।
আট মাস পরে বছরের শেষে এসিআর প্রাপ্তির সময় অবাক হলাম আমার
র্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার অধিনায়ক আমাকে অসামান্যের কাছাকাছি নম্বর দিয়ে বসে
আছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, এটা কেন? আমাকে বলল,আপনার প্রাপ্য আমি আপনাকে দিয়েছি। আমি মনে মনে বললাম,একজন অতিক্রান্ত অফিসারকে গড় ধরিয়ে দিয়ে সে বাহবা নিতে পারত। খামাখা নিজেকে বিতর্কিত
করল।
উল্লেখিত অধিনায়ক যাওয়ার পর আরও দুজন সিনিয়র অধিনায়কের সাথে
আরও ভাল চাকুরী করতে পারলাম। মনে হয় র্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার
অধিনায়কের সাথে চাকুরী আমার সহনশীলতা ও ধৈর্য বাড়িয়েছে। তারপর দিনের শেষে ল্যাপটপ
নিয়ে আমার কথাগুলো টাইপ করতে থাকলে সারা দিনের ক্লান্তি ও অপমান দূর হয়ে যায়। মনে হয় মাত্র কয়েকটা
বছর পেরলেই হয়তবা এ জটিলতা থেকে মুক্তি। সেনাপ্রধান হওয়া ছাড়া অধিকাংশই কর্মকর্তাকেই
কোন না কোন সময় র্যাংকে সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ারের সাথে চাকুরী করতে হয়। জিওসি হয়েও র্যাংকে
সিনিয়র কোর্সে জুনিয়ার সিজিএস পেতে পারে। তবে মেজর র্যাংকের চ্যালেঞ্জটা জটিল
ও ভয়াবহ। তবে জীবন থেমে থাকবে না। ছোটখাটো অপমান ও বিদ্রূপ
গায়ে না মাখিয়ে আমাদের মত অতিক্রান্ত মেজরদের কাজ করে খেতে হবে। আমার মত অভিজ্ঞতা হয়ত
অনেকের আছে তাদের সাথে অনুভূতি শেয়ার করাই আমার উদ্দেশ্য। জীবনকে নেতিবাচক না
করে চ্যালেঞ্জিং করা প্রয়োজন এমন। কি বাইরে গিয়ে চাকুরী করেও শান্তি
নাই। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলকে দেখলাম ব্যক্তি মালিকানাধীন
কোম্পানীর অর্ধশিক্ষিত মালিকদের সমীহ করতে করতে অবস্থা কাহিল। তাই সব শেষে বলতে হয়,” সুখ নাইরে পাগল” আর সুখ পেতে হলে বাড়াতে হবে ধৈর্য্য
ও সহনশীলতা।
No comments:
Post a Comment