১৯৮০ সালের দিকে আমরা হিপ্পীদের নাম শুনেছিলাম। এরা অনেকটা বন্য জীবন যাপন
করতে চাইত। অনেকটা “ফিরিয়ে দাও অরণ্য”
টাইপ। ২০০৮ সালে ধীরে ধীরে আরেকটা আন্দোলন
মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যারা শপথ নিয়েছে পৃথিবীতে ময়লা আর্বজনা কম ফেলবে বা জিরো
ওয়েস্ট মুভমেন্ট। ২০১৬ সালে এসে এটা ভাল গত পেয়েছে। উন্নত দেশের মানুষরা প্রতিদিন
গড়ে প্রায় এক কেজির কাছাকাছি ময়লা আবর্জনা ফেলে। অনেকে সমষ্টিক হিসাবে আরও বেশী
বলতে চান। আমি বছর খানেক আগে আমার একটি লেখনীতে পরিবেশ রক্ষার জন্য তিনটি “আর” এর
কথা বলেছিলাম। তা হল, রিডিউস(দ্রব্যাদির
ব্যবহার কমানো),রিইউজ(দ্রব্যাদি
পুনরায় ব্যবহার) ও রিসাইক্যাল( দ্রব্যাদি মাটিতে না ফেলে অন্য সামগ্রী তৈরি করা)।
এখনকার জিরো ওয়েস্ট মুভমেন্টের লোকজন ৫টি “আর” ভিত্তি হিসাবে নিয়েছে। তা নিন্মরুপ:
১। রিফিউজ(পরিবেশ নস্টকারী দ্রব্যাদি ফ্রি দিলেও তা রিফিউজ করা)।
২। রিডিউস(দ্রব্যাদির ব্যবহার কমানো)।
৩। রিইউজ(দ্রব্যাদি পুনরায় ব্যবহার)।
৪। রিসাইক্যাল(দ্রব্যাদি মাটিতে না ফেলে অন্য সামগ্রী তৈরি করা)।
৫। রট(অপ্রয়োজনীয় পচনশীল দ্রব্য পচিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করে মাটিতে ফেলা)।
জিরো ওয়েস্ট মুভমেন্ট প্লাস্টিক আসার আগে কখনো কারো চিন্তায় আসেনি।
প্লাস্টিকের মাধ্যমে ভয়াবহ রকম পরিবেশ দূষণ পৃথিবীর অনেক মানুষকে সচেতন করেছে।
তারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তিত ও শঙ্কিত। এই শংকা থেকে তারা
কেবলমাত্র প্লাস্টিকের আগে আমরা যেভাবে চলতাম সেই জীবন ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এ
যুগে এধরনের কার্যক্রম অত্যন্ত কঠিন একটি সাধনা ও তপস্যা। প্লাস্টিক ক্যানসারের
জন্য দায়ী এ ধারনায় স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা প্লাস্টিক বর্জন করে জিরো ওয়েস্টের
দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গুগলে জিরো ওয়েস্ট ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলে অনেক ব্লগ ও ভিডিও
পাওয়া যাবে যা থেকে আমরা এ বিষয়ে জানতে পারব। ধীরে ধীরে জিরো ওয়েস্ট পার্টির জন্য
বিশেষ মার্কেট, বিশেষ ব্যবস্থা ও
কমিউনিটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।
জিরো ওয়েস্ট আন্দোলনের অনেকে আছে যারা রিইউজেবল প্লাস্টিক ব্যবহার করে। অনেকে
আছে একদমই প্লাস্টিক ব্যবহার করে না। এরা আরও কট্টরপন্থী। অনেকে আছে অর্গানিক ফসল
ছাড়া ক্যামিক্যাল যুক্ত শস্য, সবজি বা ফল খায় না।
এখন আসি এদের জীবন ধারা কেমন। আমরা প্লাস্টিক যুগের আগে যে জীবন ধারায় ছিলাম
তারা একই জীবন ধারা মেনে চলছে।
১। তারা বাজারে যাচ্ছে ছোট, বড় বেশ কিছু কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে। এরা সমস্ত দ্রব্যাদি প্লাস্টিকের ব্যাগের
পরিবর্তে নিজেদের কাপড়ের ব্যাগে তুলে নিচ্ছে। যেসব দ্রব্যাদি তরল তার জন্য কিছু
কাচের বোতল বা বৈয়াম বহন করছে তাতে করে তরল দ্রব্যাদি ক্রয় করছে।
২। স্যানিটারি সামগ্রী সাবান, টুথপেস্ট, লোশন,
শ্যাম্পু নিজেরাই অর্গানিক সামগ্রী দিয়ে তৈরি
করে কাচের কন্টেইনারে রাখছে। বাঁশের তৈরি টুথব্রাশ ব্যবহার করছে। কাপড়ের তৈরি
স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছে। নিজে বাসায় সাবান, শ্যাম্পু, লোশন ও টুথপেস্ট
তৈরি করার রেসিপি জিরো ওয়েস্ট পার্টির ব্লগ ও ইউটিউবে আছে।
৩। এরা রিইউজের মূলনীতি মেনে পুরাতন কাপড় ব্যবহার করছে। এরা খুবই কম সংখ্যক কাপড়
ব্যবহার করে। কাপড় ছিঁড়ে গেলেও রিডিউস মূলনীতির জন্য সেলাই করে বার বার পড়তে থাকে।
এদের প্রত্যেকের কাপড়, জুতা ও অন্যান্য
সামগ্রী এত কম থাকে যে তারা যে কোন সময় যে কোন স্থানে দ্রুত বের হতে পারে। কম কাপড়
ও বিলাসী সামগ্রী না থাকার কারণে এদের রক্ষণাবেক্ষণ সময় কম ব্যয় করতে হয় এরা অনেক
সময় পায়। এর অনেক বেড়ায় ও অগানির্ক বাগান করার অনেক সময় পায়। এরা পুরাতন ও অল্প
সংখ্যক কাপড় নিয়ে এদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারী ও বেসরকারি কাজ করে যাচ্ছে।
কাপড় পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে পুনরায় পুরাতন মার্কেটে বিক্রি করে অন্য একটি পুরাতন
কাপড় কিনে নেয়।
৪। এরা খুব হিসাব করে বাজার করে যেন কোন কিছু অপচয় না হয়। প্লাস্টিকের বদলে
এরা ফ্রিজে সবজি কাচের কনটেইনারে বা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখে। সবজি ও ফল একদম
প্রয়োজন না হলে খোসা ছাড়ায় না খোসাসহ এরা রান্না করে বা খেয়ে ফেলে। এতে এদের
রান্না ঘরে খুব কম বর্জ্য হয়। যাদের বাগান আছে তারা রান্নার বর্জ্য বাগানে
কম্পোস্ট বিন রেখে তাতে কম্পোস্ট করে ফেলে। যাদের বাগান নেই তারা রান্না ঘরের
বর্জ্য ডীপ ফ্রিজে স্টিলের কনটেইনারে জমায় যাতে ঘরের মধ্যে পচে না যায় ও গণ্ধ না
হয়। প্রতিদিন ময়লা
ফেলানোর চেয়ে ফ্রিজে জমিয়ে সাপ্তাহিক ভাবে ফেনানোটা কম পরিশ্রমের। তারা তাদের ফ্রিজে
জমানো ময়লাগুলি সাপ্তাহিক ভাবে যেদিন চাষি বাজারে বাজার বাজার করতে যায় সেদিন সেখানকার
কম্পোস্ট বিনে বা প্রতিবেশীর কম্পোস্ট বিনে ফেলে আসে।
৫। এরা বর্জ্য কমানোর জন্য বড় কাগজ কিনে আমাদের আগের আমলের মতো খাতা তৈরি করে।
এরা সন্তানদের ক্যালকুলেটর পুরাতন কিনে। অর্থাৎ এরা সবই পুরাতন সামগ্রী কিনে রিইউজ
ফরমুলা মানতে।
৬। এরা সমস্ত খাদ্য সামগ্রী কাচের জারে স্টোর করে।
৭। খাবার ও অন্যান্য
সামগ্রী প্যাকেজিং এ সাধারণত গড়ে ১৫% টাকা কোম্পানিগুলো খরচ করে। এ টাকাটা
সম্পূর্ণ ভাবে আর্বজনা হিসাবে চলে যায়। জিরো ওয়েস্ট পার্টি মনে করে বিকল্প
ব্যবস্থা থাকতে খামোখা বর্জ্য হিসাবে ১৫% টাকা খরচের কোন প্রয়োজন নেই।
জিরো ওয়েস্ট পার্টি অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে প্রায় ৪০% কম টাকায় জীবন ধারণ
করতে পারে। এটার জন্য খুব যে কষ্ট করতে হবে তা নয়। কেবল জীবন যাপনের প্রক্রিয়াটা
বদলাতে হবে। এ টাকায় চলার কারণে এদের ধার কর্জ করতে হয় না। তাদের বড় একটা সেভিং
হয়। যার দ্বারা তারা অন্যদের চেয়ে বেশী পরিমাণে বিদেশ ঘুরতে পারে। পরিবেশ বান্ধব
সোলার বিদ্যুৎ সিস্টেম ক্রয় করে নিজেদের ব্যবহারের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ সোলার হতে
নিতে পারে। ব্যাটারি চালিত ও সৌরশক্তির চার্জে চালিত পরিবেশ বান্ধব উন্নত গাড়ী
ক্রয় করতে পারে। ইত্যাদি আরও অনেক কাজে তাদের সাশ্রয়ের টাকা খরচ করতে পারে। আমরা
অনেকেই পলিথিন ও অন্যান্য ব্যাগগুলি পুনরায় ব্যবহার করছি। আমরা ধীরে ধীরে আরও
সচেতন হলে জিরো ওয়েস্ট না পারি অন্তত রিডিউস ওয়েস্টে যেতে পারি। এতে আমাদের পরিবেশ
রক্ষা হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুটা কর্তব্য পালন করা হবে। এই জিরো ওয়েস্ট
পার্টির পঞ্চম স্তম্ভ অনুসরণ করলে আমাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা হবে এবং আর্থিকভাবে
আমরা লাভবান হব। এছাড়াও মিতব্যয়ীতা ধর্মীয় কাজেরও গুরুত্বপূর্ণ অনুশাসন।