আমার এক বন্ধু
আনুমানিক তিন বছর ঢাকায় থাকার পর তার পোস্টিং ঢাকার বাইরে। তার সন্তানরা পাবলিক
পরীক্ষা দিবে। বাবা মার নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন। বোন স্বামী মারা যাওয়ার পর তার
দেখাশোনা করতে হয়। একমাত্র ভাইও অসুস্থ। চরম সংকটে ঢাকা থেকে বের হয়ে আসা।
বন্ধুদের ভাইবার গ্রুপে একটি মর্মস্পর্শী পোষ্ট পাওয়ার পর আমি গভীর চিন্তায়
নিমজ্জিত হলাম। বন্ধুটি আবার আমার মতই উপ-সচিব সমতুল্য হয়ে স্থবির ভাবে চাকুরীরত।
বেতন স্থবির। পদোন্নতি স্থবির।এখন তার চাকুরী ছাড়াও সহজ। আবেদন করলে বড়জোর তিনমাস।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে পে কমিশনের সমস্ত বেতন বৃদ্ধি ও সুবিধাদি লেগেছে। আমার অপর
বন্ধু অনেক আগেই অবসর নিয়েছে। সে এই ম্যাসেজের উত্তরে জানাল বাইরে দশগুণ পরিশ্রমের
চাকুরী করে একই অর্জন। বাইরের কঠিন অবস্থার ইংগিত দিয়ে নিরুৎসাহিত করল। চাকুরীর
সময় অতিক্রান্ত না করা পর্যন্ত চাকুরী ধরে রাখার উপদেশ দিল।
একবার কোন একজন
সিনিয়র বলেছিল চাকুরীর মজা শেষ বয়সে। জুস খাওয়ার টাইম মূলত: তখনই শুরু হয়। কিন্তু
সমস্যা হল উপ-সচিব সম পর্যায়ে মূলত জুস খাওয়া হয় না বরং রগড়া খাওয়া হয়। তবে এই
পর্যায়ে পরিশ্রম বেশী করার কারণে স্বাস্থ্য ভাল থাকার সম্ভাবনা বেশী। পরিশ্রম
স্বাস্থ্য ভাল রাখে। এটা পরীক্ষিত সত্য। তাই সিভিলে গিয়ে পরিশ্রম করলে সময় খারাপ
কাটবে না। তবে আমরা অনেকে ক্যাডেট কলেজ থেকে অদ্যাবধি এমন একটা স্বাস্থ্যকর জীবনে
জড়িত যে এটা বেশ অভ্যাসের কারণে সহজ ও সাবলীল। তাই নতুনভাবে নতুন চাকুরীতে নিজেকে
নিয়োগ করাটা ৪৫-৫০ বছরের জন্য কষ্টকর। তাহলে কি করনীয় থাকতে পারে। বাড়ী করে ভাড়া
খাওয়া আর এখন পেনশন বেচতে না পাড়ার কারণে ৫০% পেনশন নেয়া। আরও কিছু সঞ্চয় থাকলে
স্ত্রীর নামে মাসিক সঞ্চয় পত্র ক্রয় করে সেখান থেকে সংসার চালনা করা। অল্প কিছু
টাকা লটারীর মত শেয়ার বাজারে খাটিয়ে “যদি লাইগ্যা যায়” করে
সেটা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করা। সকালে বিকালে হাটা। বাজার করা। ভাড়া বাড়িঘর ঠিক করার
কাজ তদারকি করা। মনের খোঁড়াক মেটানোর জন্য নিজের পছন্দমত সমাজ ও মানুষের জন্য কোন
কাজ করা ইত্যাদি। চাকুরী ছাড়ার সহজ হিসাব কোন জটিলতা নেই।
আমি আমার
অবস্থানে প্রতিমাসে ১০/১২ জন বিজিবির সদস্য আমার হাত দিয়ে পেনশনের টাকা নেয়।
বিজিবির প্রতিটি সদস্য ৫৯ বছরে সাধারণত: রিটায়ারমেন্টে যায়। আমি তাদের সাথে কথা
বলে একটা বিষয় পরিষ্কার ধারনা পাই। তাদের থাকার জন্য বাড়ী করেছে। আয়ের জন্য জমি,
ব্যবসা বা কিছু একটা গুছানো আছে। ছেলে মেয়ের পড়াশোনা শেষে চাকুরী
করছে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। তাদের সন্তানও হয়েছে। এদের সন্তানদের চাকুরী সাধারণত
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রফেসার এ ধরনের। এদের অনেকেই প্রাইভেট ভাবেই ছেলে
মেয়েদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছে। আরও আনন্দের বিষয় হল এদের অনেকেই
সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছে। বিজিবি, পুলিশ ও অন্যান্য সরকারী চাকুরীরতদের
এই ৫৯ বছরের পেনশনে যাওয়ার সফলতা দৃশ্যমান। তবে মজার বিষয় দেখলাম এদের সবাই বাড়ীতে
গেলে কি করবে এর উত্তরে বলে, হজ্ব করব আর আল্লাহ বিল্লাহ করব। এটাই
তাদের উত্তর।
“You are the best person
of Bangladesh” এ ধরনের গর্ব নিয়ে আমি ও আমার বন্ধুদের ক্যাডেট কলেজ থেকে যাত্রা
শুরু। অতঃপর প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকুরী জীবনে ৫০ বছর শেষ করে আরও ১০টি বছর নতুন
চাকুরীর সন্ধানে জীবন শুরু। ভাবলে দু:খ লাগতে পারে অন্যদের মত বেতন নিয়ে ৫৯ বছর
চাকুরী শেষ করতে পারলে মন্দ হত না। তবে আমার কাছে মনে হয় ৫০ বছরে যাওয়াটা
আনন্দদায়ক বৈকি। আমি সামর্থ্য থাকতে থাকতে অন্য একটি পরিবেশের জন্য নিজেকে তৈরি
করছি। এটা একটা ভাল দিক। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে আরও আগে এই পর্ব শেষ করা যায়।
আমি বলব ব্যবস্থা না করতে পারলে ৫০ বছর পর যাওয়াটাও মন্দ নয়। এর মধ্যে বন্ধুদের ও
জুনিয়রদের অগ্রসরমান পদোন্নতি আর মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে তাচ্ছল্য ব্যবহার
কিঞ্চিত পীড়া দিতে পারে। তবে এর জন্য দু:খ করার কিছু নেই। প্রতিটি মানুষ তার
ভাগ্যের জন্য দায়ী।
২০১৬ সালের
জুলাইয়ের বেতন বৃদ্ধির পর পর আর ২০১৭ সালের জুলাইয়ের পর পেনশন সম্পূর্ণ বিক্রির
অপশনটা উঠে যাচ্ছে। ২০১৭ জুলাইয়ের পর আমাদের মত উপ-সচিব সমপর্যায়ের ব্যক্তিরা
পেনশনে গেলে আনুমানিক হিসাবে মাসিক আয়ের চিত্রটা যেমন হতে পারে তা হল:
ক। পেনশন হিসাবে
আনুমানিক মাসে ৩৫০০০ টাকা প্রাপ্তি।
খ। এককালীন ৮০
লক্ষ টাকা প্রাপ্তি। এটা হতে মাসিক সঞ্চয়পত্র অন্য কোন মাধ্যম হতে ৭০,০০০
টাকা পাওয়া সম্ভব।
গ। সর্বসাকুল্যে
এখন রিটায়ার করলে ১,০৫,০০০ টাকা হতে পারে। এতে নিজের বাড়ী
থাকলে ও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খরচের চাপ কম থাকলে ঢাকার বাইরে চলা সম্ভব। ঢাকায়
কোন না কোন চাকুরী বা ইনকামের প্রয়োজন পড়বে।
চাকুরীতে ৫০ বছর
পর্যন্ত কষ্ট করে চাকুরী করলে এখনকার প্রেক্ষাপটে ইনকাম ট্যাক্স বাদে বেতন ৮০,০০০
টাকা আর বাড়ী ভাড়া ৩০,০০০ টাকা। কিছু লোকের সুবিধা ও গাড়ীর সুবিধায়
আরও সাশ্রয় ৫০০০ টাকা। সর্বসাকুল্যে মাসিক অর্জন ১,১৫,০০০
টাকা। তাই চাকুরী ছেড়ে পেনশন নেওয়া অপেক্ষা চাকুরী করে যাওয়ার মধ্যে কিছুটা আর্থিক
লাভ আছে। তাই যেন তেন একটা চাকুরী ৫০,০০০ টাকার উপরে হলে ঢাকায় থাকার উপযোগী
ব্যবস্থায় যাওয়া যাবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এত কমে চাকুরী করাটা কি ঠিক হবে।
আমাদের এক বন্ধু বলল মাসিক পেনশন আর পেনশনের লাভের টাকায় কষ্ট করে চলব। যদি চাকুরী
পাই তবে এই কন্ডিশনে চাকুরী করব তা হল, “যে কাজ আমাকে দিবেন করে দিব। কিন্তু সপ্তাহে দুইদিন ছুটি নিব। আর আমার খেয়াল খুশী মত আসা যাওয়া করব” এই শর্তে চাকুরী
পেলে বেতন কম হলেও চাকুরী করব। নয়ত
করব না। তবে পারিবারিক ভয়ানক সমস্যায় চাকুরী ছেড়ে দেয়াটা খারাপ অপশন নয়। আমি আমার
চাকুরী জীবনে ঢাকায় পোস্টিং পাইনি। তবে চাকুরী একদম শেষের দুইবছর ঢাকায় আসার ইচ্ছে
করছি। সন্তানদের নিয়ে শেষ প্রান্তে ঢাকায় ঢোকতে চাচ্ছি। কারণ সন্তানদের একবার
ঢাকায় নিলে এদের নিয়ে আর মফস্বলে সপরিবারে থাকতে পারব না। তাই আমাদের ফাইনাল
ডেসটিনেশন ঢাকায় চিন্তা করলে চাকুরীর মাঝে ঢাকায় ঢোকা যাবে না। ঢাকায় ঢোকতে হবে
চাকুরীর শেষ পর্যায়ে যেন ঢাকা থেকে আর বের হতে না হয়।
পরিশেষে
বলব, আমরা আমাদের ৬০% আয়ুষ্কাল হয়তবা শেষ করেছি। তাই পরিবারের ভাল চিন্তা করে
চাকুরী করলে কতটুকু আর্থিক লাভ আর ছাড়লে কতটুকু আর্থিক লস তা চিন্তা না করে পারিবারিক চাহিদাটা
হবে সবার আগে। চাকুরী ছাড়লে পারিবারিক লাভ বেশী হলে সেই অপশনটাই হবে আমাদের কাম্য।
কারণ কোন কারণে পারিবারিক বন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি হলে সেই ক্ষতিটা আর পোষানো
যাবে না। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সকলকে ভাল রাখবেন এটাই হোক আমাদের শেষ চাওয়া।