ব্যানব্যাট-১/১১ গত ২৪
সেপ্টেম্বর ২০১১ কঙ্গোতে এক বছরের জন্য মোতায়েন ছিল । বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চৌকষ
ইউনিট ১১ ইষ্ট বেঙ্গল। ইউনিটটি
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সাভার সেনানিবাস হতে অফিসার, জেসিও সহ সর্বমোট ৮৫০ জন সেনাসদস্য ব্যানব্যাট-১/১১ হিসেবে কঙ্গোতে গমন
করে।
ব্যানব্যাট-১/১১ মোতায়েনের
স্থানগুলো ছিল কঙ্গোর ওরিয়েন্টাল প্রদেশের ইতুরী জেলার বগোরো, এ্যাভেবা, বুকিরিংগী, মারাবো ও
কমান্ডা’য়। বুকিরিংগি ক্যাম্পে দুইটি প্লাটুন ছিল।অন্য চারটি স্থানে চারটি
কোম্পানী জনবলে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল । ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ছিল বুনিয়া
শহরের এ্যান্ড্রোমো ক্যাম্পে। মিশনটির
নাম ছিল “মনুষ্ক”। মিশনটি দীর্ঘদিন
ধরে চলমান।
আমি এই মিশনে ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে ব্যানব্যাট-১১
সদস্য হিসাবে গমন করি। আমার নিযুক্তি ছিল কঙ্গোর বুনিয়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের
“সাপোর্ট কোম্পানি কমান্ডার” হিসাবে। সাপোর্ট কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে আমার আর
একটি বাড়তি কাজ হল। যখন যেই কোম্পানি
কমান্ডার ছুটি যায় তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া। এই করে আমার
ব্যানব্যাটের সকল কোম্পানির ক্যাম্পে প্রতিটিতে মাসাধিকাল করে থাকা হয়। ক্যাম্পের জীবনে অপারেশন চ্যালেঞ্জ বেশী। রুটিন কাজের চাপ অনেক কম।
এই রূপ একটি রোটেশানে মেজর (২০১৮
সালে লে: কর্নেল) মাহি’র স্থানে এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমাকে আসতে হল। ক্যাম্পটিতে এর
আগে কয়েকবার বুকিরিংগি নামক একটা ক্যাম্পে যাওয়া ও আসার পথে গিয়েছি। বুকিরিংগি
অনেক ভিতরে। দুর্গম ক্যাম্প। কাঁচা রাস্তায় গাড়ী চলিয়ে যেতে হয়। ঘণ্টা ২০/২৫ কি:মি: এর বেশী গতিতে যাওয়া যায় না।
আকা বাঁকা বিপদজনক রাস্তা।
এ্যাভেবা ক্যাম্পটি একটি ছোট পাহাড়ের
উপর তৈরি করা হয়েছে। ক্যাম্পটি থেকে আসে পাশের এলাকা সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করা
যায়। মিশনের অনেক আগে থেকেই এই এলাকায় মিলিশিয়াদের অনেক পদচারণা ছিল। মাঝে মাঝে ওরা
এক দুইবার দূর থেকে এক দুই রাউন্ড ফায়ারও করে পালিয়ে যায়। ক্যাম্প কখনও ফায়ার ব্যাক করে। ফায়ারের উত্তর দেয়। আর মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষন করে। উত্তর
দেয় না। কোম্পানি কমান্ডার মেজর মাহি’র ছুটি যাওয়ার আগে বলে গেল, “আপনাকে একটা হট
সিচুয়েশনে ফেলে যাচ্ছি। আশা করি আপনি ব্যস্ত থাকবেন”।
এ্যাভেবা ক্যাম্পটা দেখতে সুন্দর।
তখনো সেখানে প্রিফেব করিমেক লাগানো হয়নি। আমাদের আগের ইউনিটগুলো টিন শেড করে গেছে।
তবে সৈনিকদের জন্য তাঁবু ছিল। তাবুতে এক বছর কাটানোটা বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ।
ক্যাম্পের পানির উৎসটা আবার ভাল ছিল। অনেক ক্যাম্পে ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে
ক্যাম্পের বাইরে হতে পানি আনতে হত। এতে ক্যাম্পের বড় একটা সময় ও জনবল পানি আনতে
নিয়োজিত থাকত। সেই হিসাবে ক্যাম্পটি আরামের। নীচে ঝরনা থেকে সাব মার্সিবল পাম্পের
সাহায্যে ক্যাম্পে পানি তোলা হত। একটা বড় ট্যাংকে মজুদ করা হত। সেখান থেকে ছোট পাম্পে পানি আবার সৈনিক বাসস্থানে আর কুক হাউজে নেয়া হত।
ক্যাম্পের পাশেই বিশাল মাঠ ছিল এই মাঠে হেলিপ্যাড তৈরি করা ছিল। আমরা সেখানে মাঝে
মাঝে স্থানীয় কংগোলীজদের সাথে বা কংগোলীজ আর্মির সাথে এই মাঠটিতে ফুটবল খেলতাম।
ক্যাম্পটার চারিদিকে পাহাড় দ্বারা ঘেরা থাকায় সিনিক বিউটি অনেক অনেক সুন্দর ছিল।
কঙ্গোর মিশনটাই আগাগোড়া একটা
চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। আমি যেই ব্যাটালিয়নের লোকেশনে ছিলাম এই একই লোকেশনে ২০০৫
সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী ক্যাপ্টেন আসাদসহ ৯ জন কমান্ডো শাহাদাত বরন করেছিল। এই
ব্যাটালিয়নের সাথে প্রায় ১৫০ জন কমান্ডো থাকে। আমার এই এ্যাভেবা ক্যাম্পেও কমান্ডো
ছিল। তারা টহলের সাথে নিয়মিত টহলে যেত। কঙ্গোর লোকজনের সাথে সম্পর্কটা ভাল ছিল।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভাষাগত ব্যবধান। ওরা স্থানীয় ভাষা সিংহলী ও ফ্রান্স
ছাড়া ইংরেজি বুঝত না। তাই ইন্টারপ্রেটার ছাড়া ওদের সাথে যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল
না। জনসাধারণের সাথে “সুপ্রভাত” বলা ছাড়া আর কোন যোগাযোগ করা যেত না। ইন্টারপ্রেটার
বেশীরভাগ ছিল কংগোলীজ। তারা কতটুকু সহি বা নির্ভুল ভাবে আমাদের কথা ইন্টারপ্রেট
করত তা অনেকটাই ডাউটফুল থাকত। কারণ আমাদের সুন্দর কথায় স্থানীয়দের তেমন সন্তুষ্ট হতে দেখা যেত না। আমি ২০০২ সালে
সিয়েরালিয়নে আর একটি মিশন করি এই মিশনে আমরা স্থানীয়দের সাথে রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে
কথা বলতাম। ওরাও সমস্যা থাকলে জানাত। ইন্টারপ্রেটার লাগত না। বিশাল একটা ভাল লাগার
অনুভূতিতে আমরা ছিলাম। আর কঙ্গো মিশনে নিজেদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বাসিন্দা মনে হত।
তবুও যতটুকু সম্ভব ইন্টারপ্রেটার নিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা
করে যেতাম। ফলাফল ভাল ছিল। কিন্তু অনেক বেশী তাদের সাথে আন্তরিক আমরা কখনো হতে
পারিনি। এটা ছিল মিশন টাইমের সবচেয়ে বড় “ড্র ব্যাক”। আর এই “ড্র ব্যাক” আমাদের বেশ কিছু ক্যাজুআলটির কারণ
থাকতে পারে বলে বলে ধারনা করা যায়। ভাষার বেরিয়ার না থাকায় সিয়েরালিয়নে যত তাড়াতাড়ি
আপন হওয়া গেছে তত তাড়াতাড়ি তাদের সাথে আপন হওয়া যাচ্ছিল না। সময় বেশী লাগছিল।
সিয়েরালিয়নে বাচ্চাদের সাথে সবচেয়ে মজা হত। বাচ্চারা আমাদের দেখলে বলত, “বাংলা গিভ মি চপ
চপ”। অর্থাৎ “বাংলা আমাদের খাবার দাও”। এখানে এই ধরনের কোন আর্জি নাই। কথা বলতে হলে ইন্টারপ্রেটার ডাক। তারপর কথা বল।
মোটামুটি মহা যন্ত্রণার বিষয় বলা যায়। আমরা কঠিন ধৈর্য ধরে তা ওভার কাম করি। তাদের
ফুটবল কিনে দিয়ে। মহিলাদের সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে। টিভি দিয়ে। ক্লাবঘর তৈরি করে। তাদের সাথে আমাদের কথাবার্তার ফারাকটা যতটুকু পারা
যায় দূর করার ব্যবস্থা করি।
কঙ্গোর সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা
অনেক দুর্বল। পাহাড়ের মাঝে রাস্তা কেটে কেটে তৈরি। বৃষ্টিতে অনেক সময় গাড়ী ফেঁসে
যায়। তবে আমরা এপিসি নিয়ে চলাচল করায় কাদায় ফাঁসায় ভয়টা কম থাকত। ছোট গাড়ীগুলি সহজেই কাদায় ফেঁসে যেত। তখন এপিসি দিয়ে এই ছোট গাড়ী গুলি তুলতে হত। আমি টহলে
গাড়ী ফেঁসে যাওয়ার এরূপ যন্ত্রণায় পড়েছি। মাঝে মাঝে এদের সিভিল ট্রাক আটকিয়ে গেলে
আমরা তুলে দিতাম। কারণ ওই ট্রাককে না তুলে দিলে আমাদের নিজেদের যাতায়তই বন্ধ হয়ে
যেত। কঙ্গোর বুনিয়া টাউনে
বাংলাদেশের ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল। এই ব্রিগেডের দুইটি বাংলাদেশী ব্যাটালিয়ন
ছিল। একটি মরক্কান ব্যাটালিয়ন ও একটি নেপালের ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ছিল। ব্রিগেডের
লজিস্টিক এরিয়া ছিল আমাদের এই বুনিয়া ক্যাম্পটি। সপ্তাহে দুইদিন। সোমবার আর বুধবার
মুভ থাকত। ওই মুভে আমরা লজিস্টিক দূরের
ক্যাম্পে পাঠাতাম।
যা বলছিলাম। বুনিয়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার থেকে ভারপ্রাপ্ত
কোম্পানি কমান্ডার হয়ে কঙ্গোর “এ্যাভেবা ক্যাম্প”এ যাই। কংগোর এ্যাভেবা
ক্যাম্পে থাকাকালীন ২২ জানুয়ারী ২০১২ তারিখ বিকালে কয়েকজন স্থানীয় কংগোলীজ আমার
সাথে দেখা করতে চাইল। আমি তাদের ডাকলাম। ক্যাম্পের গোলঘরে বসালাম। চা নাস্তা
দেয়া হল। তারা স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। সংখ্যায় তারা তিনজন। তারা এনজিওতে
কাজ করছে। তাদের একজন ভাল ইংরেজি জানে। সে জানাল, সে সিয়েরালিয়নে চাকুরী করেছে। তখন তার সাথে আমার ভাল গল্প জমে গেল। তার পরিবার
উগান্ডায় রেখেছে। সেখানে বাচ্চারা পড়াশোনা করে। কঙ্গোতে লক্ষ্য করলাম। এদের অনেকের পরিবার উগান্ডায় থাকে। কংগোলীজ
ন্যাশনাল স্টাফ বিশেষ করে ইন্টারপ্রেটাররা তাদের পরিবার নিরাপত্তার জন্য উগান্ডায়
রাখতে দেখা যায়। উগান্ডায় যাওয়ার সপ্তাহে চার দিন ফ্লাইট ছিল। তারা খুচরো
প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলল, “একটা গুরুত্বপূর্ণ
তথ্য দিতে এলাম। তোমরা সকাল দুপুর বিকাল ও রাতে টহল করছ। কিন্তু তোমাদের
টহলের মাঝের গ্যাপে কিছু মিলিশিয়া ডাকাতি ও লুট করছে। তারা একেক সময় একেক এলাকায়
যাচ্ছে। গত সপ্তাহে তারা প্রায় তিনদিন আক্রমণ করেছে তিনটি গ্রামে”। তুমি কি আমাকে সময়টা বলতে পারবে। বলল, “রাত আটটা
থেকে দশটা”। কতদিন ধরে চলছে? সে জানাল, “গত এক সপ্তাহে তিন চারটা ঘটনা ঘটেছে”। আমি জায়গা গুলোর নামগুলো জেনে ম্যাপে মার্ক
করলাম। আমি সেদিনই সন্ধ্যার টহলটার সময় পরিবর্তন করে ৭টার স্থলে ৮টা করে দিলাম।
তবে এক ঘণ্টা হাতে রাখলাম। মূলত: বের হওয়ার ইচ্ছে হল রাত ৯ টায়। এটা গোপন রাখলাম। পরে ধীরে ধীরে সময় পেছাব। নয়ত গোপনীয়তা
থাকবে না। টহল কমান্ডার হিসাবে আমি যাব। জানিয়ে দিলাম।
রাত আটটায় টহল টুআইসি সুবেদার মুনির
এসে বলল, “স্যার টহল রেডি”। আমি বললাম, কিছুক্ষণ দেরী করব। টহলকে এপিসি
থেকে নেমে টিভি দেখতে বলেন। আমি কিছুক্ষণ দেরী করে তারপর টহল শুরু করব। এর মধ্যে আমার কংগোলীজ
ইন্টারপ্রেটার দুপুর বেলা ছুটি নিয়েছে। সন্ধ্যার সময় ক্যাম্পে চলে আসবে। কংগোর
দ্বিতীয় ভাষা হল ফ্রেঞ্চ। তারা ইংরেজি বোঝে না। তাই ইন্টারপ্রেটার ছাড়া টহল করা
সম্ভব নয়। নয়টা বেজে গেল। আমি আমার টহল টুআইসি সুবেদার মুনিরকে টহল গাড়ীতে মাউন্ট
করতে বললাম। সুবেদার মুনির বলল, “টহল গাড়ীতে মাউন্ট। ইন্টারপ্রেটার নাই”। আমার বেশ রাগ হল। বললাম,অপেক্ষা করুন। সে আসুক। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করেও সে আসছিল না। আমি ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে অস্থির হয়ে বললাম, আর অপেক্ষা নয়। চলেন। ট্যাংকের মত দুই এপিসি, আমার
এক জীপ আর এক পিকাপ এফআরডিসি অর্থাৎ কংগোলীজ আর্মির জন্য ছিল। জীপে আমি,
আমার রানার, ড্রাইভার ও ইন্টারপ্রেটার নিয়ে
চারজন। দুটি এপিসিতে আটজন করে ষোল জন। সর্বশেষ পিকাপ টিতে চালক ও চালকের
পাশের সার্জেন্ট বাংলাদেশী। পিকাপের বডিতে ৮ জন কংগোলীজ আর্মি ও এফআরডিসির সৈনিক।
টহল নিয়ে বেরুনোর পথে গেইটে
হাঁপাতে হাঁপাতে এসের ইন্টারপ্রেটার হাজির। আমি মূখভর্তি ইংরেজি গালি তার উপর
ঝাড়লাম। সে বলল। দেরী করার কারণ "লুটিং ইজ গোইং অন"।
আমি একটু নমনীয় হলাম। যা চাচ্ছিলাম। তার সন্ধান পেয়ে গেলাম। আমি ইন্টারপ্রেটারকে বললাম,
তুমি সেই গ্রামে নিতে পারবে। সে বলল, “অবশ্যই
স্যার। চলেন”। তার দেখানো নির্দেশিত গ্রামে আধ ঘণ্টার মধ্যে
হাজির হলাম। আমি দেখলাম। মিলিশিয়ারা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ২জন পুরুষ ও ৩ জন মেয়েকে
আহত করেছে। আমি ফাস্ট এইড সৈনিকদের কাজে লাগিয়ে দিলাম। তখন তাদের সাথে কথা বলে
জানতে পারলাম। দশ মিনিট আগেও লুটিং করছিল। পাশের গ্রামের কংগোলিজ আর্মি তাদের ধাওয়া করেছে। আমি কোন রাস্তায় কংগোলীজ
আর্মি ধাওয়া করেছে সেই রাস্তায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গাড়ীতে উঠতে যাব।
তখন আমাদের কনভয়ের উপর ব্যাপক ফায়ার শুরু করল। আমি চিৎকার করে আমার টহলকে বললাম "লাই ডাউন ।
শুয়ে পর। ক্রল করে আড় নিয়ে ওদের আর্মসের ফ্লাশ দেখে সেই ডিরেকশানে ফায়ার
কর।"
আমি আর আমার রানার রাস্তার পাশে একটা বাড়ীর পিছনে
ছোট একটা সবজি বাগানে উঁচু করে রাখা
ময়লার ডিবিতে আড় বা কাভার নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করলাম। যেখান থেকে মিলিশিয়াদের অস্ত্রের
ফায়ারের ঝলক দেখছিলাম সেটা মনে হল ৫০০ গজ নিচে ডাউন হিলে। ডাউন হিল শুটিঙটা সুবিধা
জনক নয়। আল্লাহ ভরসা করে এসএমজি দিয়ে
সিঙ্গেল বাস্ট আর সিঙ্গেল শর্ট ফায়ার করছি। তখন ওয়াকি টকিতে আমার টহল
টুআইসি সুবেদার মুনির বলল, “এপিসি থেকে ফায়ার করব স্যার”। আমি বললাম, ওদের উইপনের ফ্লাশের ডিরেকশানে ফায়ার
করেন। এপিসিতে আবার স্ট্রেসার রাউন্ড ছিল। ১২.৭ এমজির গগনবিদারী শব্দে ফায়ার
শুরু। আমরা এপিসি ফায়ার শুরুর পর এসএমজি ফায়ার বন্ধ রাখলাম। এপিসি ফায়ারের দুই
মিনিট পর ওয়াকি টকিতে ক্যাপ্টেন পারভেজ ক্যাম্প থেকে বলল, “স্যার। এপিসির ফায়ার বন্ধ করেন। বেইজ ক্যাম্পের উপর দিয়ে
ট্রেসার যাচ্ছে”। আমি এপিসির ফায়ার বন্ধ করলাম। রাতের অন্ধকারে আন্দাজে ফায়ার করতেছি। কোলেটারাল
ড্যামেজ হতে পারে। সকালবেলা গ্রামবাসী লাশ নিয়ে হাজির হতে পারে। এদিকে আমাদের
সাথে থাকা এফআরডিসির টহল সদস্যরা দুইজন
মিলিশিয়াকে ধরে ফেলেছে। দুই মিলিশিয়ার হাতে লাঠি ছিল। এখানে বলে রাখি। ডাকাতি হওয়া গ্রামটিতে জানতে পেরেছিলাম,
মিলিশিয়াদের ৫/৬ জনের হাতে ছিল একে ৪৭। বাকী ১০/১২ জনের হাতে ছিল লাঠি।
এই লাঠি পার্টির দুইজন ধরা পরেছে
এফআরডিসির হাতে। গ্রামের শেষে ঘরটি থেকে বেরুতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। এরা ডাকাতি
শেষে মনে হয় ঘরের মালামাল খোঁজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। এরই মধ্যে এইচএফ সেটে
আমার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল ইফতেখারের সাথে কথা বললাম। উনাকে বললাম, আমি মিলিশিয়াদের ধাওয়া করব কিনা। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন।
তোমার ওখানে আরো দুটি এপিসি আন। একজন
অফিসার আন। তারপর স্থানীয়দের আরো জিঞ্জাসাবাদ
কর। তারপর সিদ্ধান্ত নাও। আমি বুঝলাম
পুরো আয়োজন শেষে আর এদের পিছনে ধাওয়া করা লাভ হরে না। স্বাভাবিক কারণে
কন্টিনজেন্ট কমান্ডার টহলের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। “হিরোইজম" নয়। অত:পর ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন সিরাজ দুইটি এপিসি নিয়ে হাজির। সব কিছু মিলে প্রায় এক
ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন সিরাজকে বললাম, ব্রাদার ব্যাটল ইজ ওভার। চল টহল করে ক্যাম্পে ফেরত যাই। তার পর চারিদিকে আরো
ঘণ্টা খানেক সময় ব্যয় করে টহল শেষ করে এফআরডিসি ক্যাম্পে আসলাম। এখানে জানিয়ে
রাখি। আমরা যেই দুইজন
মিলিশিয়া ধরতে পেরেছিলাম তা আমরা এফআরডিসি কোম্পানি সদরে পাঠিয়ে ছিলাম। এটাই নিয়ম
ছিল। ধৃত আসামী এফআরডিসিকে হস্তান্তর করা হত। কারণ গ্রামে কোন কংগোলিজ পুলিশ নাই।
পুলিশই কার্যক্রম তারাই করত। আমি এফআরডিসি ক্যাম্পে গিয়ে দেখলাম, দুই মিলিশিয়াকে
দুইটি গর্তের মধ্যে প্রত্যেককে আন্ডারওয়্যার পরিহিত অবস্থায় চারটি খুঁটি দিয়ে
হাতপা ছড়িয়ে পশুর মত বেঁধে রেখেছে। আমি ইন্টারপ্রেটারের মাধ্যমে কোম্পানি
কমান্ডারকে বললাম, জেনেভা কনভেনশনের যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ম অনুসারে যেন এই দুই
বন্দীকে ট্রিট করা হয়। আমার এই কথা ইন্টারপ্রেটার বলার পর মনে হল কোম্পানি
কমান্ডার ক্ষেপে গেল। সে ইন্টারপ্রেটারের সাথে চিৎকার করতে লাগল। আমি
ইন্টারপ্রেটারের কাছে জানতে চাইলাম, কোম্পানি কমান্ডার ক্ষেপে গেল কেন?
ইন্টারপ্রেটার বলল, “সে বলল,সে জানে কি করতে হবে। ইউএন দিক নির্দেশনা না দিলেও
চলবে”। আমি না বোঝার ভান করে
থাকলাম। আমি ইন্টারপ্রেটারকে বললাম,কোম্পানি কমান্ডারকে বলে দাও, তার রাগের কারণটা
অতি সংগত। কারণ মিলিশিয়ারা অনেক রকম অপরাধ করছে। যতই রাগ থাকুক, ধৈর্য ধরে তারা যেন তাদের
জিঞ্জাসাবাদ করে ও পরে ব্যাটালিয়ন সদরে বা তাদের ব্রিগেড সদরে পাঠিয়ে দেয়।
আসার পথে ইন্টারপ্রিটারকে জিঞ্জাসা
করলাম। এফআরডিসি কোম্পানি কমান্ডার প্রিজনারকে নিয়ে কি করবে। সে বলল। তুমি যেভাবে
দেখছ। এভাবে বেঁধে তারা তাদের জিঞ্জাসাবাদ করবে। জিঞ্জাসাবাদ শেষে বুকে বেয়নেট
দিয়ে বা গলা কেটে মেরে ওই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিবে। যদি উঁচু দরের মিলিশিয়া হয়,
তবে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ব্যাটালিয়ন সদরে নিবে। অন্যথায় ছোট খাট মিলিশিয়া সদস্য
হলে কোম্পানি কমান্ডার মেরে মাটা চাপা দিয়ে দিবে। আমার মন বলল, এটা অন্যায়।
আমি অপস অফিসারকে জানালাম। ওরা মনে
হয় ধৃত দুই মিলিশিয়াকে মেরে ফেলবে। আমাকে তিনি বললেন মূলত: আমাদের কাছ থেকে
কংগোলীজ পুলিশ বা পুলিশ না থাকলে তাদের আর্মির কাছে হস্তান্তর করার কথা এর বাইরে
যাওয়া সুযোগ নেই। তিনি আমাকে অবজারভারদের জানিয়ে রাখতে বললেন। তারা খোঁজ খবর নিতে পারে। আমি বুঝলাম আসলে কিছু করার
নেই। বিচার এখানে নেই। মানব অধিকার নেই। তবে এটাও চিন্তা করলাম যারা আমার উপর গুলি
চালাতে পারে তাদের উপর কোন দরদ দেখিয়ে আসলে কোন লাভ নেই।
ক্যাম্পে আসার পর বুট খুলতে খুলতে
না খুলতেই পুনরায় অপস অফিসারের ফোন। তাকে এ টু জেট বর্ণনা দিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে। তারপর তিনি বললেন, রিপোর্টটা
জরুরী পাঠান। লাও ঠেলা। এবার অফিসের বাবুকে ডেকে পুরো ঘটনটা বর্ণনা করে সিটরেপ টাইপ করে
ফ্যাক্স করতে বললাম। রাতের খাবার খেলাম ২টায়। কারণ ইচ্ছে ছিল টহল থেকে এসের রাত দশটায় ডিনার করব। ভুল পরিকল্পনা ছিল। হেড কোয়ার্টারে সিটরেপ পাঠাতে
পাঠাতে কখন যে রাত দুইটা বেজে গেল টেরই পেলাম না। আমার ইচ্ছে হল পরদিন যেখানে
ফায়ার করেছিলাম সেই স্থানে দিনের
আলোতে পর্যবেক্ষন করা।
ঘুম ভাঙ্গল সকাল সাড়ে ছয়টায়। সাথে সাথে ইউনিফরম পড়ে একটি স্থানে কিছু
রক্তমাখা ঘাস পাতা পেলাম। বুঝা গেল আন্দাজে ফায়ার করে কোন মিলিশিয়াকে হয়ত আহত করা
গেছে। অথবা বন্য প্রাণীও গুলি খেতে পারে। কংগোর সুদূর গ্রাম থেকে রক্তের স্যাম্পল পাঠিয়ে মানুষের রক্ত না পশুর রক্ত
নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না।
এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমাদের দিনগুলো
বেশ ট্রমাতে কাটত। মাঝ রাতে দুই তিন কি:মি: দূরে মিলিশিয়াদের ফায়ারের শব্দ শোনা যেত।
হয়ত এরা লুটিং করছে বা নিজেরা আন্ত কলহে ফায়ার করছে। এধরনের ফায়ারে রাতে আমরা “স্ট্যান্ড
টু” করতে বাধ্য হতাম। ফলে রাতের ঘুম হারাম। এভাবে প্রতি সপ্তাহে তিন/চার দিন “স্ট্যান্ড
টু” ও “ফলস এ্যালার্ম” চলতে থাকে। ফায়ারের শব্দ রাতে অনেক দূর হতে পাওয়া যায়।
তারপরও তা তোয়াক্কা করতে হয়। কারণ, এটা আক্রমণের পূর্ব লক্ষণ কিনা তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। তাই “স্ট্যান্ড টু” না হয়ে পারা যাচ্ছে না। গুলির
শব্দের সাথে আমার শ্রবণের একটা ভয়ানক রকম স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়েছে। একদিন রাত
দুইটায় গুলির মত শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাফ দিয়ে উঠে হাফ প্যান্ট গেঞ্জির উপর
ইউনিফরম পড়ে গুলির ব্যাগগুলি কাঁধে চাপিয়ে এসএমজি হাতে নিয়ে আমার পেরিমিটার
ব্যাংকারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল সৌনিকদের স্ট্যান্ড টুর দৌড়াদৌড়ি ও শোরগোল
নেই। তখন মনে হল, আমি কি ভুল করলাম। আমার এক সার্জেন্ট এগিয়ে এসে বলল, “স্যার আপনি এসএমজি নিয়ে বের হলেন”। আমি বললাম ,ফায়ার হল। তোমরা স্ট্যান্ড টু করছ না কেন। সে বলল, “না তো স্যার। ফায়ার হয়নি”। আমি যে শব্দ শুনলাম। সে বলল, আমি তো স্যার রাত
১১ টা থেকে জেগে আছি কোন শব্দ কানে আসেনি। আপনি মনে হয় ভুল শুনেছেন। আমি বললাম ,শব্দে ঘুম
ভাঙ্গল আর আমি চলে আসলাম। তুমি বলছ ভুল শুনেছি। অবাক করা ব্যাপার। তার সাথে কথা বলে বলে আগাচ্ছি। মনে
হল ঘুম যেহেতু ভাগল। ছয়টা সেন্ট্রি পোস্ট আছে। প্রতিটি পোস্টে দুইজন করে ১২ জন প্রহড়ারত
আছে। তাদের সাথে কথা বলেই
যাই। একটি পোস্টে কথা বলে অন্য একটা পোস্টে দিকে আগাচ্ছি। হঠাৎ একটা খোলা ঘরের টিন পড়ে আছে দেখলাম। আমি সার্জেন্টকে
বললাম, টিনটা পড়া কেন। সে বলল, বাতাসে আমাদের নামাজের ঘরের বারান্দার টিনটা ছুটে এসে পড়েছে। সার্জেন্ট
আমাকে বলল, “এখনও বাতাস বইছে তবে অনেক কমেছে। কিছুক্ষণ আগে
বাতাসটা আরো প্রখর ছিল। টিনটা উড়ে আসার সময় অনেক জোরে শব্দ হয়েছিল। এই শব্দটাই
ঘুমের গোড়ে ফায়ারের শব্দ মনে হতে পারে স্যার”। এখন আমার কাছে মনে হল, এটাই হয়েছে। নির্ধিদ্বায় বলা যায়। পরের দিন। ব্রেক ফাস্টের
টেবিলে আমার অন্য তিনজন অফিসারদের সাথে ঘটনাটা শেয়ার করলাম। তাদের হাঁসি আর থামতে
চায় না। সিরাজ বলল, ফায়ার আর স্ট্যান্ড টু গল্প কোম্পানী টুআইসি রাফি’র কাছে অনেক
শুনতে পারবেন। কোম্পানী টুআইসি রাফি আবার তখন বুকিরিংগি ক্যাম্পে ছিল। বুকিরিংগি
ক্যাম্পটি আবার এই এ্যাভেবা ক্যাম্পের কমান্ড ও লজিস্টিক সাপোর্টে চলছিল। তাদের
সকলেরই রাতে একাধিকার শব্দ শুনে “স্ট্যান্ড টু” হওয়ার অভিঞ্জতা আছে। এটা একটা
ট্রমাটাইজ সিচুয়েশন। আমাদের ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার লে: কর্নেল নাসির আমার
সিনিয়র। স্যারকে বললাম, উত্তরণের উপায় কি? তিনি বললেন, “সকালে ও বিকালে পিটি গেমস বাড়িয়ে দাও। শরীর ক্লান্ত থাকলে
ডীপ স্লিপ হবে। তখন টুটকা ফটকা শব্দে তেমন সমস্যা হবে না। আর একটা বিষয়। সত্যিকারের ফায়ারে
শব্দ হলে কন্ট্রোল কল করবে। ডিউটি এনসিও ও ডিউটি জেসিও ডেকে তুলবে। নো টেনশন”। আমি বললাম, ভালই বলছেন। নো টেনশন। আর টেনশনেই আমার ঘুম আসে না। আমরা
অফিসাররা যেখানে থাকতাম। ওটা ছিল একটা টিনের ঘর। বাতাসে টিনের ঘরে বিচিত্র শব্দ করে। পুটুস পাটুস, ফটাস ফটাস মনে হয় দূরের ফায়ারের শব্দ। এখানে এই রূপ ট্রমাটিক
সিচুয়েশন বড়ই পীড়াদায়ক। ক্যাম্পের চারজন অফিসারের মধ্যে দুইজন অনেক রাত জেগে থাকে।
আবার দুইজন আগে ঘুমায় ও খুব ভোরে উঠে। চারজনের দুই ধরনের অভ্যাস থাকায় কোম্পানী
কমান্ডার হিসাবে আমার কাছে ভালই মনে হল। রাতের অর্ধেক অটোমেটিক পাহাড়া হয়ে যাচ্ছে।
আর খুব ভোরেও পাহাড়া হয়ে যাচ্ছে। মিলিশিয়াদের ডন এট্যাক, ডাস্ক
এ্যাটাক ও মিড নাইট এ্যাটাক সিচুয়েশন কাভার করার জন্য আমার কোম্পানির লোকজন সতর্ক
আছে।
এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমার প্রথম
রাতের কথা মনে পড়ল সেদিন রাত দেড়টায়ও আমরা জেগে আছি। টিভি দেখছি। হঠাৎ টাশ টাশ
শব্দ। মনে হল বেশী দূরেও নয়। সাথে সাথে। আমাদের একটা পোস্ট থেকে এলএমজি’র ঘন ঘন বাস্ট ফায়ার। আমরা দুই
অফিসার ছুটলাম। ফায়ার রত এল এমজি পোস্টের দিকে। চিৎকার করে ফায়ার বন্ধ করালাম। জানতে চাইলাম, কেন ফায়ার করছ। সে বলল,“স্যার এই
দিক থেকে ফায়ার এসেছিল”। আমি জানতে চাইলাম, তুমি কি ফ্লাশ দেখেছ। সে বলল, “জী স্যার”। আমি বললাম, তুমি ফায়ারের শব্দ শুনেছ। ফায়ার করেছ।
আমরা এমটি কার্টির্জ গুনে দেখলাম। ৭৫ রাউন্ড ফায়ার করেছে। আমি সেন্ট্রিকে বললাম, তোমাকে
ফায়ার করল দুই রাউন্ড। আর তুমি ফায়ার করলে ৭৫ রাউন্ড এটা কেমন করে হয়। আমার খুব রাগ হল। পরে কন্টিনজেন্ট
কমান্ডার কর্নেল ইফতেখারের সাথে আলোচনা করলাম। তিনি ধীর স্থিরভাবে বললেন, “এটা হল,ব্যাটল
ফিল্ড স্ট্রেস। তোমার সৈনিক স্ট্রেসড অবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফায়ার করেছে। বকা বকির
প্রয়োজন নাই। সৈনিকদের মোটিভেশন ও রিফ্রেশর ট্রেনিং বাড়িয়ে দাও”। “পরের দিন এক শত্রু এক বুলেট”এ উপর ট্রেনিং চলতে
লাগল। এখানে বলে রাখি মিশন এরিয়ার স্ট্রেসড সিচুয়েশন রিমুভ করার জন্য সকালে পিটি ও
বিকালে গেইমস ক্যাম্পে চালু ছিল। এছাড়া ইউএন খাবার অনেক উন্নত যা বার্ন করার জন্য
নিয়মিত পিটি ও গেইমসের কোন বিকল্প নাই। এটা না করলে সৈনিকের ওভার ওয়েট ঠেকানো দায়
হয়ে যেত। ডিউটি ব্যতীত বাকী ইউনিফরম পড়া অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের রিফ্রেশর ট্রেনিং ছিল প্রতিদিনের রুটিনের
অংশ। বাংলাদেশী পীস কিপাররা অনেক বেশী প্রফেশনাল কার্যক্রম সাধারণত ইউএন
ডেপ্লমেন্টে প্রদর্শন করে থাকে। এতে বাংলাদেশের সুনাম আছে।
সেই সৈনিকের মধ্য রাতের ফায়ারের
ঘটনার পর মধ্য রাতে আমার মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যেত। একটু শব্দ হলেই কান খাড়া হয়ে
যেত। পরদিন এফআরডিসির লিয়াজু অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম। গতকাল রাতের ফায়ারের
কারণ কি। শুনলাম ক্যাম্প থেকে আনুমানিক ৭০০ গজ দূরে মিলিশিয়ারা লুটিং করার জন্য
গ্রামে ঢুকে ছিল। গ্রামে ঢোকার আগে এরা দুই এক রাউন্ড ফায়ার করে ওরা প্যানিক ক্রিয়েট
করে। আমি তাকে বললাম, এক সপ্তাহ আগে এদের ধাওয়া করলাম। দুইজন ধরলাম। তবে এরা আবার
সাহস পেল কিভাবে এখানে আসার জন্য। সে বলল, “আপনাদের
ধাওয়া খেয়েছে যারা তদের বদলী করে মিলিশিয়াদের নতুন গ্রুপ এসেছে এই এলাকায়
সন্ত্রাসী কাজ করার জন্য”। আমি এফআরডিসির এলওকে বললাম, আমরা এই এলাকা থেকে মিলিশিয়াদের মূল উৎপাটন করতে
চাই। তুমি তাদের তথ্য সংগ্রহ করে দাও। কোথায় এদের হাইড আউট রয়েছে এবং কোন ট্রেইল
ধরে যাতায়ত করে। হাইড আউট জানা গেলে হেলিকপ্টার গান শিপ দিয়ে এ্যাটাক করা যেতে
পারে। ট্রেইল জানা গেলে এ্যামব্বুশ করা যেতে পারে। সহযোগীতার আশ্বাস দিয়ে এলও
বিদায় নিল।
এলওরা এফআরডিসির অফিসার। তারা ইউএন ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এরা
তথ্য দিয়ে সহায়তা করে থাকে। টহলেও অংশগ্রহণ করে থাকে। এদের অনেক এলও ইংরেজি জানে। আবার দীর্ঘদিন বছরের পর বছর কাজ করে এদের অনেকে
বাংলাও জানে। আমি বুকিরিংগি নামক একটা ক্যাম্পে থাকতে একজন এলওর সাথে এমন সখ্যতা
হয় সে অনেক দিন আমি বাংলাদেশে চলে আসার পরও ফোন করত।
কঙ্গোর ব্যানব্যাট-১ এর এলাকার
বুকিরিংগি আর এ্যাভেবা ক্যাম্পগুলি মিলিশিয়া অধ্যুষিত এলাকা ছিল। এখানে ফায়ারের
শব্দ আর মিলিশিয়াদের শুটিং ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মিলিশিয়াদের সাথে কংগোলীজ
আর্মির এফআরডিসি ও ইউএন ফোর্সের লাগাতার “টম এন্ড জেরী” খেলা চলতে থাকে। একদিকে
মিলিশিয়া গেলে এফআরডিসি আর ইউাএন ফোর্স ধাওয়া করল। আবার মিলিশিয়ারা অন্যদিকে চলে যায়। এভাবে খেলা চলতে চলতে কন্টিনজেন্টের এক বছর সময় চলে
যায়। বৌ বাচ্চার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সৈনিকদের আকুতি বাড়ে। চোখে খুশির চমক আসতে
থাকে। নতুন দল নতুন চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে “টম এন্ড জেরী খেলা”র জন্য প্রস্তুতি
নিতে থাকে। পুরাতন দল সাদা ধবধবে প্লেনে চড়ে যখন দেশে ফিরে তখন ভয়ানক শান্তি আর
ভয়ানক ট্রমা থেকে স্বস্থি। এভাবে চলতে থাকে নতুন পুরাতনের বদল। নতুন নতুন খেলা।
রক্তারক্তির খেলা। ২০১৮ সালে প্রথমে যখন লেখাটি লেখছি তখনও চলছে। কবে শেষ হবে কেউ জানে না।