Pages

Wednesday, February 28, 2018

কংগোর এ্যাভেবা ক্যাম্প ও রক্তারক্তির খেলা


ব্যানব্যাট-১/১১ গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ কঙ্গোতে এক বছরের জন্য মোতায়েন ছিলবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চৌকষ ইউনিট ১১ ইষ্ট বেঙ্গলইউনিটটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সাভার সেনানিবাস হতে অফিসার, জেসিও সহ সর্বমোট ৮৫০ জন সেনাসদস্য ব্যানব্যাট-১/১১ হিসেবে কঙ্গোতে গমন করে

ব্যানব্যাট-১/১১ মোতায়েনের স্থানগুলো ছিল কঙ্গোর ওরিয়েন্টাল প্রদেশের ইতুরী জেলার বগোরো, এ্যাভেবা, বুকিরিংগী, মারাবো ও কমান্ডা’য়। বুকিরিংগি ক্যাম্পে দুইটি প্লাটুন ছিল।অন্য চারটি স্থানে চারটি কোম্পানী জনবলে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ছিল বুনিয়া শহরের এ্যান্ড্রোমো ক্যাম্পে মিশনটির নাম ছিল “মনুষ্ক” মিশনটি দীর্ঘদিন ধরে চলমান।



আমি এই মিশনে ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে ব্যানব্যাট-১১ সদস্য হিসাবে গমন করি। আমার নিযুক্তি ছিল কঙ্গোর বুনিয়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের “সাপোর্ট কোম্পানি কমান্ডার” হিসাবে। সাপোর্ট কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে আমার আর একটি বাড়তি কাজ হল যখন যেই কোম্পানি কমান্ডার ছুটি যায় তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া এই করে আমার ব্যানব্যাটের সকল কোম্পানির ক্যাম্পে প্রতিটিতে মাসাধিকাল করে থাকা হয়ক্যাম্পের জীবনে অপারেশন চ্যালেঞ্জ বেশী। রুটিন কাজের চাপ অনেক কম।
এই রূপ একটি রোটেশানে মেজর (২০১৮ সালে লে: কর্নেল) মাহি’র স্থানে এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমাকে আসতে হল। ক্যাম্পটিতে এর আগে কয়েকবার বুকিরিংগি নামক একটা ক্যাম্পে যাওয়া ও আসার পথে গিয়েছি। বুকিরিংগি অনেক ভিতরে দুর্গম ক্যাম্প। কাঁচা রাস্তায় গাড়ী চলিয়ে যেতে হয় ঘণ্টা ২০/২৫ কি:মি: এর বেশী গতিতে যাওয়া যায় না। আকা বাঁকা বিপদজনক রাস্তা।

এ্যাভেবা ক্যাম্পটি একটি ছোট পাহাড়ের উপর তৈরি করা হয়েছে। ক্যাম্পটি থেকে আসে পাশের এলাকা সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। মিশনের অনেক আগে থেকেই এই এলাকায় মিলিশিয়াদের অনেক পদচারণা ছিল। মাঝে মাঝে ওরা এক দুইবার দূর থেকে এক দুই রাউন্ড ফায়ারও করে পালিয়ে যায়ক্যাম্প কখনও ফায়ার ব্যাক করে ফায়ারের উত্তর দেয়। আর মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষন করে। উত্তর দেয় না। কোম্পানি কমান্ডার মেজর মাহি’র ছুটি যাওয়ার আগে বলে গেল, “আপনাকে একটা হট সিচুয়েশনে ফেলে যাচ্ছি। আশা করি আপনি ব্যস্ত থাকবেন”
এ্যাভেবা ক্যাম্পটা দেখতে সুন্দর। তখনো সেখানে প্রিফেব করিমেক লাগানো হয়নি। আমাদের আগের ইউনিটগুলো টিন শেড করে গেছে। তবে সৈনিকদের জন্য তাঁবু ছিল। তাবুতে এক বছর কাটানোটা বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ। ক্যাম্পের পানির উৎসটা আবার ভাল ছিল। অনেক ক্যাম্পে ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে হতে পানি আনতে হত। এতে ক্যাম্পের বড় একটা সময় ও জনবল পানি আনতে নিয়োজিত থাকত। সেই হিসাবে ক্যাম্পটি আরামের। নীচে ঝরনা থেকে সাব মার্সিবল পাম্পের সাহায্যে ক্যাম্পে পানি তোলা হত। একটা বড় ট্যাংকে মজুদ করা হত সেখান থেকে ছোট পাম্পে পানি আবার  সৈনিক বাসস্থানে আর কুক হাউজে নেয়া হত। ক্যাম্পের পাশেই বিশাল মাঠ ছিল এই মাঠে হেলিপ্যাড তৈরি করা ছিল। আমরা সেখানে মাঝে মাঝে স্থানীয় কংগোলীজদের সাথে বা কংগোলীজ আর্মির সাথে এই মাঠটিতে ফুটবল খেলতাম। ক্যাম্পটার চারিদিকে পাহাড় দ্বারা ঘেরা থাকায় সিনিক বিউটি অনেক অনেক সুন্দর ছিল।
কঙ্গোর মিশনটাই আগাগোড়া একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। আমি যেই ব্যাটালিয়নের লোকেশনে ছিলাম এই একই লোকেশনে ২০০৫ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী ক্যাপ্টেন আসাদসহ ৯ জন কমান্ডো শাহাদাত বরন করেছিল। এই ব্যাটালিয়নের সাথে প্রায় ১৫০ জন কমান্ডো থাকে। আমার এই এ্যাভেবা ক্যাম্পেও কমান্ডো ছিল। তারা টহলের সাথে নিয়মিত টহলে যেত। কঙ্গোর লোকজনের সাথে সম্পর্কটা ভাল ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভাষাগত ব্যবধান। ওরা স্থানীয় ভাষা সিংহলী ও ফ্রান্স ছাড়া ইংরেজি বুঝত না। তাই ইন্টারপ্রেটার ছাড়া ওদের সাথে যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল না। জনসাধারণের সাথে “সুপ্রভাত” বলা ছাড়া আর কোন যোগাযোগ করা যেত না। ইন্টারপ্রেটার বেশীরভাগ ছিল কংগোলীজ। তারা কতটুকু সহি বা নির্ভুল ভাবে আমাদের কথা ইন্টারপ্রেট করত তা অনেকটাই ডাউটফুল থাকত। কারণ আমাদের সুন্দর কথায় স্থানীয়দের  তেমন সন্তুষ্ট হতে দেখা যেত না। আমি ২০০২ সালে সিয়েরালিয়নে আর একটি মিশন করি এই মিশনে আমরা স্থানীয়দের সাথে রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে কথা বলতাম। ওরাও সমস্যা থাকলে জানাত। ইন্টারপ্রেটার লাগত না। বিশাল একটা ভাল লাগার অনুভূতিতে আমরা ছিলাম। আর কঙ্গো মিশনে নিজেদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বাসিন্দা মনে হত। তবুও যতটুকু সম্ভব ইন্টারপ্রেটার নিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যেতাম। ফলাফল ভাল ছিল। কিন্তু অনেক বেশী তাদের সাথে আন্তরিক আমরা কখনো হতে পারিনি। এটা ছিল মিশন টাইমের সবচেয়ে বড় “ড্র ব্যাক”আর এই “ড্র ব্যাক” আমাদের বেশ কিছু ক্যাজুআলটির কারণ থাকতে পারে বলে বলে ধারনা করা যায়। ভাষার বেরিয়ার না থাকায় সিয়েরালিয়নে যত তাড়াতাড়ি আপন হওয়া গেছে তত তাড়াতাড়ি তাদের সাথে আপন হওয়া যাচ্ছিল না। সময় বেশী লাগছিল। সিয়েরালিয়নে বাচ্চাদের সাথে সবচেয়ে মজা হত বাচ্চারা আমাদের দেখলে বলত, “বাংলা গিভ মি চপ চপঅর্থাৎ “বাংলা আমাদের খাবার দাও”এখানে এই ধরনের কোন আর্জি নাই। কথা বলতে হলে ইন্টারপ্রেটার ডাক। তারপর কথা বল। মোটামুটি মহা যন্ত্রণার বিষয় বলা যায়। আমরা কঠিন ধৈর্য ধরে তা ওভার কাম করি। তাদের ফুটবল কিনে দিয়ে মহিলাদের সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে। টিভি দিয়ে ক্লাবঘর তৈরি করে তাদের সাথে আমাদের কথাবার্তার ফারাকটা যতটুকু পারা যায় দূর করার ব্যবস্থা করি
কঙ্গোর সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। পাহাড়ের মাঝে রাস্তা কেটে কেটে তৈরি। বৃষ্টিতে অনেক সময় গাড়ী ফেঁসে যায়। তবে আমরা এপিসি নিয়ে চলাচল করায় কাদায় ফাঁসায় ভয়টা কম থাকতছোট গাড়ীগুলি সহজেই কাদায় ফেঁসে যেততখন এপিসি দিয়ে এই ছোট গাড়ী গুলি তুলতে হত। আমি টহলে গাড়ী ফেঁসে যাওয়ার এরূপ যন্ত্রণায় পড়েছি। মাঝে মাঝে এদের সিভিল ট্রাক আটকিয়ে গেলে আমরা তুলে দিতাম। কারণ ওই ট্রাককে না তুলে দিলে আমাদের নিজেদের যাতায়তই বন্ধ হয়ে যেতকঙ্গোর বুনিয়া টাউনে বাংলাদেশের ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল। এই ব্রিগেডের দুইটি বাংলাদেশী ব্যাটালিয়ন ছিল। একটি মরক্কান ব্যাটালিয়ন ও একটি নেপালের ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ছিল। ব্রিগেডের লজিস্টিক এরিয়া ছিল আমাদের এই বুনিয়া ক্যাম্পটি। সপ্তাহে দুইদিন। সোমবার আর বুধবার মুভ থাকত। ওই মুভে আমরা  লজিস্টিক দূরের ক্যাম্পে পাঠাতাম।

যা বলছিলাম বুনিয়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার থেকে ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার হয়ে কঙ্গোর “এ্যাভেবা ক্যাম্প”এ যাই। কং‌গোর এ্যা‌ভেবা ক্যাম্পে থাকাকালীন ২২ জানুয়ারী ২০১২ তারিখ বিকালে কয়েকজন স্থানীয় কং‌গোলীজ আমার সাথে দেখা কর‌তে চাইল। আমি তা‌দের ডাকলাম। ক্যাম্পের গোলঘ‌রে বসালাম। চা নাস্তা দেয়া হল। তারা স্থানীয় এক‌টি প্রতিষ্ঠানে কাজ ক‌রে। সংখ্যায় তারা তিনজন। তা‌রা এন‌জিওতে কাজ করছে। তাদের একজন ভাল ইংরেজি জানে। সে জানাল, সে সিয়েরালিয়নে চাকুরী করেছেতখন তার সাথে আমার ভাল গল্প জমে গেল। তার পরিবার উগান্ডায় রেখেছে। সেখানে বাচ্চারা পড়াশোনা করে। কঙ্গোতে লক্ষ্য করলাম এদের অনেকের পরিবার উগান্ডায় থাকে। কংগোলীজ ন্যাশনাল স্টাফ বিশেষ করে ইন্টারপ্রেটাররা তাদের পরিবার নিরাপত্তার জন্য উগান্ডায় রাখতে দেখা যায়। উগান্ডায় যাওয়ার সপ্তাহে চার দিন ফ্লাইট ছিল। তারা খুচ‌রো প্রসঙ্গ বাদ দি‌য়ে বলল, “একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দি‌তে এলাম। তোমরা সকাল দুপুর বিকাল ও রা‌তে টহল করছ। কিন্তু তোমা‌দের টহলের মাঝের গ্যাপে কিছু মিলিশিয়া ডাকাতি ও লুট করছে। তারা একেক সময় একেক এলাকায় যাচ্ছে। গত সপ্তাহে তারা প্রায় তিনদিন আক্রমণ করেছে তিনটি গ্রামে”তুমি কি আমা‌কে সময়টা বল‌তে পারবে। বলল, “রাত আটটা থেকে দশটা”কতদিন ধ‌রে চলছে? সে জানাল, “গত এক সপ্তাহে তিন চারটা ঘটনা ঘটেছে”আমি জায়গা গু‌লোর নামগু‌লো জেনে ম্যাপে মার্ক করলাম। আমি সেদিনই সন্ধ্যার টহলটার সময় পরিবর্তন করে ৭টার স্থলে ৮টা ক‌রে দিলাম। তবে এক ঘণ্টা হা‌তে রাখলাম। মূলত: বের হওয়ার ইচ্ছে  হল রাত ৯ টায়। এটা গোপন রাখলাম।  প‌রে ধী‌রে ধী‌রে সময় পেছাব। নয়ত গোপনীয়তা থাকবে না। টহল কমান্ডার হিসাবে আমি যাব জানিয়ে দিলাম।
রাত আটটায় টহল টুআইসি সু‌বেদার মুনির এসে বলল, “স্যার টহল রেডি”আমি বললাম, কিছুক্ষণ দেরী করব। টহল‌কে এপিসি থেকে নেমে টি‌ভি দেখ‌তে বলেন। আমি কিছুক্ষণ দেরী ক‌রে তারপর  টহল শুরু করব। এর মধ্যে আমার কং‌গোলীজ ইন্টারপ্রেটার দুপুর বেলা ছুটি নিয়েছে। সন্ধ্যার সময় ক্যাম্পে চলে আস‌বে। কং‌গোর দ্বিতীয় ভাষা হল ফ্রেঞ্চ। তারা ইংরেজি বো‌ঝে না। তাই ইন্টারপ্রেটার ছাড়া টহল করা সম্ভব নয়। নয়টা বেজে গেল। আমি আমার টহল টুআ‌ইসি সুবেদার মুনিরকে টহল গাড়ীতে মাউন্ট কর‌তে বললাম। সু‌বেদার মুনির বলল, “টহল গাড়ীতে মাউন্ট। ইন্টারপ্রেটার নাই”আমার বেশ রাগ হলবললাম,অপেক্ষা করুন সে আসুক৩০ মিনিট অপেক্ষা ক‌রেও সে আসছিল না। আমি ঘড়ির দি‌কে তাকিয়ে অস্থির হ‌য়ে বললাম, আর অপেক্ষা নয় চলেন। ট্যাংকের মত দুই এপিসি, আমার এক জীপ আর এক পিকাপ এফআর‌ডি‌সি অর্থাৎ কং‌গোলীজ আর্মির জন্য ছিল। জীপে আমি, আমার রানার, ড্রাইভার ও ইন্টারপ্রেটার নি‌য়ে চারজন। দু‌টি এপিসি‌তে আটজন ক‌রে ষোল জন। সর্বশেষ পিকাপ টি‌তে চালক ও চালকের পাশের সার্জেন্ট বাংলাদেশী পিকা‌পের বডিতে ৮ জন কং‌গোলীজ আর্মি ও এফআরডি‌সির সৈনিক।
টহল নি‌য়ে বেরুনোর পথে গেইটে হাঁপা‌তে হাঁপাতে এসের ইন্টারপ্রেটার হাজির। আমি মূখভর্তি ইংরেজি গালি তার উপর ঝাড়লাম। সে বলল দেরী করার কারণ "লু‌টিং ইজ গোইং অন"
আমি একটু নমনীয় হলাম। যা চাচ্ছিলাম তার সন্ধান পেয়ে গেলাম। আমি ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, তুমি সেই  গ্রামে নি‌তে পারবে। সে বলল, “অবশ্যই স্যার চলেন”তার দেখা‌নো নির্দেশিত গ্রামে আধ ঘণ্টার মধ্যে হাজির হলাম। আমি দেখলাম। মিলিশিয়ারা লাঠি দি‌য়ে পিটিয়ে ২জন পুরুষ ও ৩ জন মেয়েকে আহত করেছে। আমি ফাস্ট এইড সৈনিকদের কাজে লাগিয়ে দিলাম। তখন তা‌দের সাথে কথা বলে জান‌তে পারলাম। দশ মিনিট আগেও লু‌টিং করছিল। পাশের গ্রামের কং‌গো‌লিজ আর্মি  তা‌দের ধাওয়া করেছে। আমি কোন রাস্তায় কংগোলীজ আর্মি ধাওয়া করেছে সেই রাস্তায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নি‌য়ে গাড়ী‌তে উঠ‌তে যাব। তখন আমা‌দের কনভ‌য়ের উপর ব্যাপক ফায়ার শুরু করল। আমি  চিৎকার ক‌রে আমার টহলকে বললাম "লাই ডাউন । শু‌য়ে পর। ক্রল ক‌রে আড় নিয়ে ওদের আর্মসের ফ্লাশ দেখে সেই ডি‌রেকশা‌নে ফায়ার কর।"
আমি  আর আমার রানার রাস্তার পাশে একটা বাড়ীর পিছনে ছোট একটা সবজি  বাগানে উঁচু ক‌রে রাখা ময়লার ডিবিতে আড় বা কাভার নি‌য়ে ফায়ার কর‌তে শুরু করলাম। যেখান থেকে মিলিশিয়াদের অস্ত্রের ফায়ারের ঝলক দেখছিলাম সেটা মনে হল ৫০০ গজ নিচে ডাউন হিলে। ডাউন হিল শুটিঙটা সুবিধা জনক নয়। আল্লাহ ভরসা ক‌রে এসএম‌জি দি‌য়ে  সিঙ্গেল বাস্ট আর সিঙ্গেল শর্ট ফায়ার করছি। তখন ওয়া‌কি টকিতে আমার টহল টুআইসি সু‌বেদার মুনির বলল, “এপিসি থেকে ফায়ার করব স্যার”আমি বললাম, ওদের উইপনের ফ্লাশের ডি‌রেকশা‌নে ফায়ার করেন। এপি‌সি‌তে আবার স্ট্রেসার রাউন্ড ছিল। ১২.৭ এম‌জির গগনবিদারী শব্দে ফায়ার শুরু। আমরা এপি‌‌সি ফায়ার শুরুর পর এসএম‌জি ফায়ার বন্ধ রাখলাম। এপি‌সি ফায়ারের দুই মিনিট পর ওয়া‌কি টকিতে ক্যাপ্টেন পার‌ভেজ ক্যাম্প থেকে বলল, “স্যার এপি‌সির ফায়া‌র বন্ধ করেন। বেইজ ক্যাম্পের উপর দি‌য়ে ট্রেসার যাচ্ছে”আমি এপিসির ফায়ার বন্ধ করলাম। রাতের অন্ধকারে আন্দাজে ফায়ার করতেছি। কো‌লেটারাল ড্যামেজ হতে পা‌রে। সকালবেলা গ্রামবাসী লাশ নি‌য়ে হাজির হ‌তে পা‌রে। এদিকে আমা‌দের সাথে থাকা এফআর‌ডি‌সির টহল সদস্যরা  দুইজন মিলিশিয়াকে ধ‌রে ফেলেছে। দুই মিলিশিয়ার হা‌তে লাঠি ছিল। এখানে বলে রাখি ডাকাতি হওয়া গ্রাম‌টি‌তে জান‌তে পেরেছিলাম, মিলিশিয়াদের ৫/৬ জনের হা‌তে ছিল একে ৪৭। বাকী ১০/১২ জনের হা‌তে ছিল লাঠি
এই লাঠি পার্টির দুইজন ধরা পরেছে এফআরডি‌সির হা‌তে। গ্রামের শেষে ঘর‌টি থেকে বেরুতে গি‌য়ে ধরা খেয়েছে। এরা ডাকাতি শেষে মনে হয় ঘরের মালামাল খোঁজ কর‌তে গি‌য়ে ধরা খেয়েছে। এরই মধ্যে এইচএফ সেটে আমার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল ইফতেখারের সাথে কথা বললাম। উনা‌কে বললাম, আমি মিলিশিয়াদের ধাওয়া করব কিনা। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন। তোমার ওখানে আরো  দু‌টি এপি‌সি আন। একজন অফিসার আন। তারপর স্থানীয়‌দের আরো  জিঞ্জাসাবাদ কর তারপর সিদ্ধান্ত নাও। আমি  বুঝলাম পুরো আয়োজন শেষে আর এদের পিছনে ধাওয়া করা লাভ হরে না। স্বাভাবিক কারণে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার টহলের নিরাপত্তা নি‌য়ে চিন্তিত। “হি‌রোইজম" নয়।  অত:পর ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন সিরাজ দুইটি  এপিসি নি‌য়ে হাজির। সব কিছু মিলে প্রায় এক ঘণ্টা পার হ‌য়ে‌ গেছে। ক্যাপ্টেন সিরাজ‌কে বললাম, ব্রাদার ব্যাটল ইজ ওভার চল টহল ক‌রে ক্যাম্পে ফেরত যাই। তার পর চারিদিকে আরো ঘণ্টা খানেক সময় ব্যয় ক‌রে টহল শেষ ক‌রে এফআরডিসি ক্যাম্পে আসলাম। এখানে জানিয়ে রাখি আমরা যেই দুইজন মিলিশিয়া ধরতে পেরেছিলাম তা আমরা এফআরডিসি কোম্পানি সদরে পাঠিয়ে ছিলাম। এটাই নিয়ম ছিল। ধৃত আসামী এফআরডিসিকে হস্তান্তর করা হত। কারণ গ্রামে কোন কংগোলিজ পুলিশ নাই। পুলিশই কার্যক্রম তারাই করত। আমি এফআরডিসি ক্যাম্পে গিয়ে দেখলাম, দুই মিলিশিয়াকে দুইটি গর্তের মধ্যে প্রত্যেককে আন্ডারওয়্যার পরিহিত অবস্থায় চারটি খুঁটি দিয়ে হাতপা ছড়িয়ে পশুর মত বেঁধে রেখেছে। আমি ইন্টারপ্রেটারের মাধ্যমে কোম্পানি কমান্ডারকে বললাম, জেনেভা কনভেনশনের যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ম অনুসারে যেন এই দুই বন্দীকে ট্রিট করা হয়। আমার এই কথা ইন্টারপ্রেটার বলার পর মনে হল কোম্পানি কমান্ডার ক্ষেপে গেল। সে ইন্টারপ্রেটারের সাথে চিৎকার করতে লাগল। আমি ইন্টারপ্রেটারের কাছে জানতে চাইলাম, কোম্পানি কমান্ডার ক্ষেপে গেল কেন? ইন্টারপ্রেটার বলল, “সে বলল,সে জানে কি করতে হবে। ইউএন দিক নির্দেশনা না দিলেও চলবে”আমি না বোঝার ভান করে থাকলাম। আমি ইন্টারপ্রেটারকে বললাম,কোম্পানি কমান্ডারকে বলে দাও, তার রাগের কারণটা অতি সংগত কারণ মিলিশিয়ারা অনেক রকম অপরাধ করছে। যতই রাগ থাকুক, ধৈর্য ধরে তারা যেন তাদের জিঞ্জাসাবাদ করে ও পরে ব্যাটালিয়ন সদরে বা তাদের ব্রিগেড সদরে পাঠিয়ে দেয়।
আসার পথে ইন্টারপ্রিটারকে জিঞ্জাসা করলাম। এফআরডিসি কোম্পানি কমান্ডার প্রিজনারকে নিয়ে কি করবে। সে বলল। তুমি যেভাবে দেখছ। এভাবে বেঁধে তারা তাদের জিঞ্জাসাবাদ করবে। জিঞ্জাসাবাদ শেষে বুকে বেয়নেট দিয়ে বা গলা কেটে মেরে ওই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিবে। যদি উঁচু দরের মিলিশিয়া হয়, তবে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ব্যাটালিয়ন সদরে নিবে। অন্যথায় ছোট খাট মিলিশিয়া সদস্য হলে কোম্পানি কমান্ডার মেরে মাটা চাপা দিয়ে দিবে। আমার মন বলল, এটা অন্যায়।
আমি অপস অফিসারকে জানালাম। ওরা মনে হয় ধৃত দুই মিলিশিয়াকে মেরে ফেলবে। আমাকে তিনি বললেন মূলত: আমাদের কাছ থেকে কংগোলীজ পুলিশ বা পুলিশ না থাকলে তাদের আর্মির কাছে হস্তান্তর করার কথা এর বাইরে যাওয়া সুযোগ নেই। তিনি আমাকে অবজারভারদের জানিয়ে রাখতে বললেনতারা খোঁজ খবর নিতে পারে। আমি বুঝলাম আসলে কিছু করার নেই। বিচার এখানে নেই। মানব অধিকার নেই। তবে এটাও চিন্তা করলাম যারা আমার উপর গুলি চালাতে পারে তাদের উপর কোন দরদ দেখিয়ে আসলে কোন লাভ নেই।
ক্যাম্পে আসার পর বুট খুল‌তে খুল‌তে না খুল‌তেই পুনরায় অপস অফিসারের ফোন তা‌কে এ টু জেট বর্ণনা দিলাম প্রায় ঘন্টাখা‌নেক ধ‌রে। তারপর তিনি বললেন, রি‌পোর্টটা জরুরী পাঠানলাও ঠেলা। এবার অফিসের বাবু‌কে ডে‌কে পুরো ঘটনটা বর্ণনা ক‌রে সিটরেপ টাইপ করে ফ্যাক্স করতে বললাম। রাতের খাবার খেলাম ২টায়কারণ ইচ্ছে ছিল টহল থেকে এসের রাত দশটায় ডিনার করবভুল পরিকল্পনা ছিল। হেড‌ কোয়ার্টারে সিট‌রেপ পাঠা‌তে পাঠা‌তে কখন যে রাত দুইটা বেজে গেল টেরই পেলাম না। আমার ইচ্ছে হল পরদিন যেখানে ফায়ার করেছিলাম সেই  স্থানে দিনের আলোতে  পর্য‌বেক্ষন করা।
ঘুম ভাঙ্গল সকাল সাড়ে ছয়টায়।  সাথে সাথে ইউনিফরম পড়ে একটি স্থানে কিছু রক্তমাখা ঘাস পাতা পেলাম। বুঝা গেল আন্দাজে ফায়ার ক‌রে কোন মিলিশিয়াকে হয়ত আহত করা গেছে। অথবা বন্য প্রাণীও গুলি খে‌তে পা‌রে। কং‌গোর সুদূর গ্রাম থেকে রক্তের  স্যাম্পল পাঠিয়ে মানুষের রক্ত না পশুর রক্ত নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না।
এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমাদের দিনগুলো বেশ ট্রমাতে কাটত। মাঝ রাতে দুই তিন কি:মি: দূরে মিলিশিয়াদের ফায়ারের শব্দ শোনা যেত। হয়ত এরা লুটিং করছে বা নিজেরা আন্ত কলহে ফায়ার করছে। এধরনের ফায়ারে রাতে আমরা “স্ট্যান্ড টু” করতে বাধ্য হতাম। ফলে রাতের ঘুম হারাম। এভাবে প্রতি সপ্তাহে তিন/চার দিন “স্ট্যান্ড টু” ও “ফলস এ্যালার্ম” চলতে থাকে। ফায়ারের শব্দ রাতে অনেক দূর হতে পাওয়া যায়। তারপরও তা তোয়াক্কা করতে হয় কারণ, এটা আক্রমণের পূর্ব লক্ষণ কিনা তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। তাই স্ট্যান্ড টুনা হয়ে পারা যাচ্ছে না। গুলির শব্দের সাথে আমার শ্রবণের একটা ভয়ানক রকম স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়েছে। একদিন রাত দুইটায় গুলির মত শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাফ দিয়ে উঠে হাফ প্যান্ট গেঞ্জির উপর ইউনিফরম পড়ে গুলির ব্যাগগুলি কাঁধে চাপিয়ে এসএমজি হাতে নিয়ে আমার পেরিমিটার ব্যাংকারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল সৌনিকদের স্ট্যান্ড টুর দৌড়াদৌড়ি ও শোরগোল নেই। তখন মনে হল, আমি কি ভুল করলাম। আমার এক সার্জেন্ট এগিয়ে এসে বলল, “স্যার আপনি এসএমজি নিয়ে বের হলেন”আমি বললাম ,ফায়ার হল তোমরা স্ট্যান্ড টু করছ না কেন। সে বলল, “না তো স্যার ফায়ার হয়নি”আমি যে শব্দ শুনলাম। সে বলল, আমি তো স্যার রাত ১১ টা থেকে জেগে আছি কোন শব্দ কানে আসেনিআপনি মনে হয় ভুল শুনেছেন। আমি বললাম ,শব্দে ঘুম ভাঙ্গল আর আমি চলে আসলাম তুমি বলছ ভুল শুনেছি। অবাক করা ব্যাপার। তার সাথে কথা বলে বলে আগাচ্ছি। মনে হল ঘুম যেহেতু ভাগল। ছয়টা সেন্ট্রি পোস্ট আছে। প্রতিটি পোস্টে দুইজন করে ১২ জন প্রহড়ারত আছে তাদের সাথে কথা বলেই যাই। একটি পোস্টে কথা বলে অন্য একটা পোস্টে দিকে আগাচ্ছি হঠাৎ একটা খোলা ঘরের টিন পড়ে আছে দেখলাম। আমি সার্জেন্টকে বললাম, টিনটা পড়া কেন। সে বলল, বাতাসে আমাদের নামাজের ঘরের বারান্দার টিনটা ছুটে এসে পড়েছে। সার্জেন্ট আমাকে বলল, “এখনও বাতাস বইছে তবে অনেক কমেছে। কিছুক্ষণ আগে বাতাসটা আরো প্রখর ছিল। টিনটা উড়ে আসার সময় অনেক জোরে শব্দ হয়েছিল। এই শব্দটাই ঘুমের গোড়ে ফায়ারের শব্দ মনে হতে পারে স্যার”এখন আমার কাছে মনে হল, এটাই হয়েছে নির্ধিদ্বায় বলা যায়। পরের দিন। ব্রেক ফাস্টের টেবিলে আমার অন্য তিনজন অফিসারদের সাথে ঘটনাটা শেয়ার করলাম। তাদের হাঁসি আর থামতে চায় না। সিরাজ বলল, ফায়ার আর স্ট্যান্ড টু গল্প কোম্পানী টুআইসি রাফি’র কাছে অনেক শুনতে পারবেন। কোম্পানী টুআইসি রাফি আবার তখন বুকিরিংগি ক্যাম্পে ছিল। বুকিরিংগি ক্যাম্পটি আবার এই এ্যাভেবা ক্যাম্পের কমান্ড ও লজিস্টিক সাপোর্টে চলছিল। তাদের সকলেরই রাতে একাধিকার শব্দ শুনে “স্ট্যান্ড টু” হওয়ার অভিঞ্জতা আছে। এটা একটা ট্রমাটাইজ সিচুয়েশন। আমাদের ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার লে: কর্নেল নাসির আমার সিনিয়র। স্যারকে বললাম, উত্তরণের উপায় কি? তিনি বললেন, “সকালে ও বিকালে পিটি গেমস বাড়িয়ে দাও। শরীর ক্লান্ত থাকলে ডীপ স্লিপ হবে তখন টুটকা ফটকা শব্দে তেমন সমস্যা হবে না। আর একটা বিষয়। সত্যিকারের ফায়ারে শব্দ হলে কন্ট্রোল কল করবেডিউটি এনসিও ও ডিউটি জেসিও ডেকে তুলবে। নো টেনশন”আমি বললাম, ভালই বলছেন নো টেনশন। আর টেনশনেই আমার ঘুম আসে না। আমরা অফিসাররা যেখানে থাকতাম ওটা ছিল একটা টিনের ঘর। বাতাসে টিনের ঘরে বিচিত্র শব্দ করে। পুটুস পাটুস, ফটাস ফটাস মনে হয় দূরের ফায়ারের শব্দ। এখানে এই রূপ ট্রমাটিক সিচুয়েশন বড়ই পীড়াদায়ক। ক্যাম্পের চারজন অফিসারের মধ্যে দুইজন অনেক রাত জেগে থাকে। আবার দুইজন আগে ঘুমায় ও খুব ভোরে উঠে। চারজনের দুই ধরনের অভ্যাস থাকায় কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে আমার কাছে ভালই মনে হল। রাতের অর্ধেক অটোমেটিক পাহাড়া হয়ে যাচ্ছে। আর খুব ভোরেও পাহাড়া হয়ে যাচ্ছে। মিলিশিয়াদের ডন এট্যাক, ডাস্ক এ্যাটাক ও মিড নাইট এ্যাটাক সিচুয়েশন কাভার করার জন্য আমার কোম্পানির লোকজন সতর্ক আছে।
এ্যাভেবা ক্যাম্পে আমার প্রথম রাতের কথা মনে পড়ল সেদিন রাত দেড়টায়ও আমরা জেগে আছি। টিভি দেখছি। হঠাৎ টাশ টাশ শব্দ। মনে হল বেশী দূরেও নয়সাথে সাথে। আমাদের একটা পোস্ট থেকে এলএমজি’র ঘন ঘন বাস্ট ফায়ার। আমরা দুই অফিসার ছুটলাম ফায়ার রত এল এমজি পোস্টের দিকেচিৎকার করে ফায়ার বন্ধ করালাম। জানতে চাইলাম, কেন ফায়ার করছ। সে বলল,“স্যার এই দিক থেকে ফায়ার এসেছিল”আমি জানতে চাইলাম, তুমি কি ফ্লাশ দেখেছ। সে বলল, “জী স্যার”আমি বললাম, তুমি ফায়ারের শব্দ শুনেছ। ফায়ার করেছ। আমরা এমটি কার্টির্জ গুনে দেখলাম। ৭৫ রাউন্ড ফায়ার করেছে। আমি সেন্ট্রিকে বললাম, তোমাকে ফায়ার করল দুই রাউন্ড আর তুমি ফায়ার করলে ৭৫ রাউন্ড এটা কেমন করে হয়। আমার খুব রাগ হল। পরে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল ইফতেখারের সাথে আলোচনা করলাম। তিনি ধীর স্থিরভাবে বললেন, “এটা হল,ব্যাটল ফিল্ড স্ট্রেসতোমার সৈনিক স্ট্রেসড অবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফায়ার করেছে। বকা বকির প্রয়োজন নাই। সৈনিকদের মোটিভেশন ও রিফ্রেশর ট্রেনিং বাড়িয়ে দাও”“পরের দিন এক শত্রু এক বুলেট”এ উপর ট্রেনিং চলতে লাগল। এখানে বলে রাখি মিশন এরিয়ার স্ট্রেসড সিচুয়েশন রিমুভ করার জন্য সকালে পিটি ও বিকালে গেইমস ক্যাম্পে চালু ছিল। এছাড়া ইউএন খাবার অনেক উন্নত যা বার্ন করার জন্য নিয়মিত পিটি ও গেইমসের কোন বিকল্প নাই। এটা না করলে সৈনিকের ওভার ওয়েট ঠেকানো দায় হয়ে যেত। ডিউটি ব্যতীত বাকী ইউনিফরম পড়া অবস্থায় বিভিন্ন  ধরনের রিফ্রেশর ট্রেনিং ছিল প্রতিদিনের রুটিনের অংশ। বাংলাদেশী পীস কিপাররা অনেক বেশী প্রফেশনাল কার্যক্রম সাধারণত ইউএন ডেপ্লমেন্টে প্রদর্শন করে থাকে। এতে বাংলাদেশের সুনাম আছে।
সেই সৈনিকের মধ্য রাতের ফায়ারের ঘটনার পর মধ্য রাতে আমার মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যেত। একটু শব্দ হলেই কান খাড়া হয়ে যেত। পরদিন এফআরডিসির লিয়াজু অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম। গতকাল রাতের ফায়ারের কারণ কি। শুনলাম ক্যাম্প থেকে আনুমানিক ৭০০ গজ দূরে মিলিশিয়ারা লুটিং করার জন্য গ্রামে ঢুকে ছিল। গ্রামে ঢোকার আগে এরা দুই এক রাউন্ড ফায়ার করে ওরা প্যানিক ক্রিয়েট করে। আমি তাকে বললাম, এক সপ্তাহ আগে এদের ধাওয়া করলাম। দুইজন ধরলাম। তবে এরা আবার সাহস পেল কিভাবে এখানে আসার জন্য। সে বলল, “আপনাদের ধাওয়া খেয়েছে যারা তদের বদলী করে মিলিশিয়াদের নতুন গ্রুপ এসেছে এই এলাকায় সন্ত্রাসী কাজ করার জন্য” আমি এফআরডিসির এলওকে বললাম, আমরা এই এলাকা থেকে মিলিশিয়াদের মূল উৎপাটন করতে চাই। তুমি তাদের তথ্য সংগ্রহ করে দাও। কোথায় এদের হাইড আউট রয়েছে এবং কোন ট্রেইল ধরে যাতায়ত করে। হাইড আউট জানা গেলে হেলিকপ্টার গান শিপ দিয়ে এ্যাটাক করা যেতে পারে। ট্রেইল জানা গেলে এ্যামব্বুশ করা যেতে পারে। সহযোগীতার আশ্বাস দিয়ে এলও বিদায় নিল।
এলওরা এফআরডিসির অফিসার তারা ইউএন ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে থাকে। টহলেও অংশগ্রহণ করে থাকে। এদের অনেক এলও ইংরেজি জানে আবার দীর্ঘদিন বছরের পর বছর কাজ করে এদের অনেকে বাংলাও জানে। আমি বুকিরিংগি নামক একটা ক্যাম্পে থাকতে একজন এলওর সাথে এমন সখ্যতা হয় সে অনেক দিন আমি বাংলাদেশে চলে আসার পরও ফোন করত
কঙ্গোর ব্যানব্যাট-১ এর এলাকার বুকিরিংগি আর এ্যাভেবা ক্যাম্পগুলি মিলিশিয়া অধ্যুষিত এলাকা ছিল। এখানে ফায়ারের শব্দ আর মিলিশিয়াদের শুটিং ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মিলিশিয়াদের সাথে কংগোলীজ আর্মির এফআরডিসি ও ইউএন ফোর্সের লাগাতার “টম এন্ড জেরী” খেলা চলতে থাকে। একদিকে মিলিশিয়া গেলে এফআরডিসি আর ইউাএন ফোর্স ধাওয়া করল। আবার মিলিশিয়ারা অন্যদিকে চলে যায়এভাবে খেলা চলতে চলতে কন্টিনজেন্টের এক বছর সময় চলে যায়। বৌ বাচ্চার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সৈনিকদের আকুতি বাড়ে। চোখে খুশির চমক আসতে থাকে। নতুন দল নতুন চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে “টম এন্ড জেরী খেলা”র জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পুরাতন দল সাদা ধবধবে প্লেনে চড়ে যখন দেশে ফিরে তখন ভয়ানক শান্তি আর ভয়ানক ট্রমা থেকে স্বস্থি। এভাবে চলতে থাকে নতুন পুরাতনের বদল। নতুন নতুন খেলা। রক্তারক্তির খেলা। ২০১৮ সালে প্রথমে যখন লেখাটি লেখছি তখনও চলছেকবে শেষ হবে কেউ জানে না।

Thursday, February 22, 2018

রে‌মিট্যান্স সন্মান

জানুয়ারি ২০১৮ সালে শেষ সপ্তাহে আমার এক পাঠক দুবাই থেকে ফোন করলেন। তিনি দুবাই‌য়ের এক‌টি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন। বাংলাদেশের কুমিল্লায় তার বাড়ী। বাড়ীতে স্ত্রী ও ছেলে আছে। তিনি অনেক বছর ধ‌রে দুবাই আছেন। ওখানে এক‌টি প্রতিষ্ঠানে ইন হাউস জব করেন। অনেকের চে‌য়ে ভাল আছেন। অনেক বাংলাদেশী দুবাইয়ে আছে  যারা রাস্তা ও কনস্ট্রাকশা‌নে অনেক ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন ক‌রে। সে হিসাবে তিনি ভাল আছেন। তা‌কে সাধুবাদ দিলাম। তিনি আমার ফেইস বুক লেখা পড়ে আমার সাথে যোগা‌যোগ করার জন্য উৎসাহিত হ‌য়ে‌ছেন। কথা বলার জন্য আগ্রহী হ‌য়ে‌ছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, “আমরা যে এত কষ্ট ক‌রে বিদেশে থেকে দেশের জন্য টাকা পাঠাচ্ছি।  তার কি কোন দাম নেই। মূল্যায়ন নেই”। আমি একটু অবাক হলাম। কেন বলছেন একথা। অবশ্যই দেশ মূল্যায়ন করছে। 
তাহলে বলি আপনা‌কে কষ্টটা। তিনি শুরু করলেন। গত বছর ছুটি শেষে আসার সময় বাংলাদেশের এয়ার‌পোর্টে বলল, আপনি কবে বাংলাদেশে এসেছেন। আমি  বললাম, তারিখটা আমার মনে নাই। পাস‌পোর্ট আপনার কাছে। ওখান থেকে বাংলাদেশে আসার তারিখ দেখে নেন প্লিজ। বাংলাদেশের এয়ার‌পোর্টের সেই লোক রেগে গেল। বলল, ঠিক আছে অপেক্ষা করেন। এভাবে কারণ ছাড়া আমা‌কে আধ ঘণ্টা দাড় করিয়ে রাখল। দীর্ঘদিন থেকে এই ঘটনায় অপমানিত বোধ করছিলাম। আপনা‌কে আজ বলে শান্তি পেলাম। তখন একটু ইমো‌শনাল হ‌য়ে বললেন, “আমরা কি রে‌মিট্যন্স অবদানের সন্মানটুকু পে‌তে পারি না
"রে‌মিট্যান্স সন্মান"। এটা কি একটা টার্ম বা শব্দ সং‌যোজন হতে পা‌রে তা‌দের সন্মান অর্জনের জন্য। প‌রে আর একটা বিষয় তিনি জানালেন। তা হল, পাস‌পোর্টের মেয়াদ শেষা‌ন্তে রি‌নিউ কর‌তে পড়তে হয় আরেক যুদ্ধের মধ্যে। বাংলাদেশের দুবাইয়ের পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ বলেন, আজ আসেন, তো কাল আসেন। এভাবে সময় ও খরচ বাড়‌তে থা‌কে। সে তখন দু:খ ক‌রে বলল, দুবাই ওয়ালারা বাঙ্গালীদের চে‌কিং করা ও ভে‌রি‌ফি‌কেশ‌নে খুব সচেতন। কোন দাপ্তরিক কাজে দুবাই ওয়ালারাও এত সময় নেয় না। আমা‌দের দেশের দাপ্তরিক ব্যবস্থাপনা অনুন্নত অথবা তারা আমা‌দের অসন্মান করা‌নোর জন্য ঘুরা‌তে থা‌কে। এটা শুনে আমি আর একটু কষ্ট পেলাম।
আমা‌দের দেশ মধ্যম আ‌য়ের দেশের পথে আছে। জি‌ডি‌পি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর পিছনে প্রবাসী ভাইদে‌র অবদান অনেক। কয়েকটা টাকা প্রাপ্তি আর একটু সুখের আশার তা‌রা ভয়াবহ সে‌ক্রিফাইজ ক‌রে যাচ্ছে। এরা যখন অসন্মা‌নিত হয় তখন সত্যিই তা কষ্টকর বিষয়।
করদাতা স্বীকৃত হচ্ছেন। রেমিট্যান্স দাতারা স্বীকৃত হচ্ছেন না। কারণ তারা ছোট ছোট ইনকাম করে। এই ছোট ছোট ইনকাম ও সেক্রিফাইজে দেশে ব্যবসা গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে ইমারত। গ্রামে টিনের ঘরগুলো পাকা হচ্ছে। ঘরে ঘরে জীবন যাত্রার মান বাড়ছে। প্রবাসীদের ভাই বোন ছেলে মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের কষ্টার্জিত টাকায় তাদের বাবা মারা স্বস্থি পাচ্ছে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে তারা স্ত্রীদের রেখে যাচ্ছে। নিজেরা বিরূপ পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কঠিন আবহাওয়ার মধ্যে পরিশ্রম করছে। প্রতিটি প্রবাসীর উপর কম বেশী গড়ে ৪/৫ জন মানুষ নির্ভরশীল। এই কারণে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যতার সীমা থেকে উঠে এসেছে।

কস্টসহিঞ্চু ও সেকরিফাইজ করার এই মানুষগুলোকে আমাদের অসন্মান করাটা অপরাধ নয়কি। অবশ্যই অপরাধ। তাদের কষ্টের সন্মানটুকু দিতে হবে। স্কিলড ম্যান পাওয়ার পাঠাতে আমরা পারিনি এটা রাষ্ট্রের সমস্যা। যারা আন স্কিলড হয়ে অনেক অনেক পরিশ্রম করছে। দেশ তাদের সন্মানের আসনে অবশ্যই রাখতে হবে। অন্যথায় জাতি হিসাবে আমাদের সম্মান থাকবে না। বিদেশে বাংলাদেশীরা কেউ বিপদে পড়লে তারা পরস্পরকে সাহায্য করে। তারপরও সহজে কিছু করতে পারে না। সব সময় ভয় কখন কোন দোষে আরবরা তাদের বের করে দেয়। সমস্যা হল যত ছোট চাকুরী তত সমস্যা। তবে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আনা প্রয়োজন। তাদের মাঝে নিরাপত্তা ও মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের করনীয় অনেক বিষয় আছে। আর কিছু না হোক তাদের জন্য আমাদের রেমিট্যান্স সন্মানএর মানুষিকটা সমাজের সর্বস্তরে চালু করতে হবে।

Thursday, February 15, 2018

সমস্ত স্কুল ও কলেজে চালু হোক সততা ক্যান্টিন


আমি সামরিক সদস্য হিসাবে একবার একটি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে মজাদার একটি ব্যবস্থা দেখে ছিলাম। তা হল অফিসারদের টি বা স্ন্যাকস খাওয়ার স্থানে যাকে ফিল্ড মেস ব‌লে সেখানে সকল খাবার সাজানো আছে। সবাই যার যার মত নিয়ে খাবে। যাওয়ার সময় যার যার মত চিট লিখে বাক্সে ফেলত। সপ্তাহ শেষে কোন চিট কম কিনা অডিট রিপোর্ট আসত। যারা লিখতে ভুলে গেছে তারা চিট লিখত ও হিসাব মিলাত। মূলত সিগারেট খোর পার্টি হিসাবের গড়মিল বেশী করত। যদি হিসাব একান্তই না মিলত ও কারো ভুল মনে না পড়ত তবে সবাই ভাগাভাগি করে ক্ষয়ক্ষতি পেমেন্ট করত। এটা হত কালে ভদ্রে। বেশীর ভাগ সময়ই হিসাব মিলে যেত।
আমার চাকুরী জীবনে চার বছর চাকুরীতে এই অনুশীলনটি ভাল লেগেছিল। কিছুদিন আগে ফেইসবুক লেখনী থেকে জানলাম অনেক দেশে এই ধরনের অনেক শপ আছে যেটায় কোন দোকানদার নেই। কুষ্টিয়ার কুমারখালির রেল স্টেশনে এক ব্যক্তি এই ধরনের সততা দোকান দিয়েছে যেখানে গামছা লুঙ্গি ও অন্য কাপড় বিক্রি হয়। যারা কিনবে তারা মূল্য দেখে বাক্সে পরিশোধ করে। মজার বিষয় হল এই দোকান থেকে কিছু হারানোর পর তার লাভও হচ্ছে। এই দুইটি ধারনার পর আমার কাছে মনে হল আমাদের ভবিষত জেনারেশনের জন্য এই পদ্ধতিতে যাচ্ছি না কেন।
আমরা প্রতিটি স্কুলে সততা ক্যান্টিন স্থাপন করতে পারি। স্কুলে এই ক্যান্টিন স্থাপন করলে আমরা ছোট থেকে সততার ট্রেনিং দিতে পারব। স্কুলের প্রতিটি বাচ্চা তার খাতা, বই,চকলেট যাবতীয় অনেক দ্রব্যাদি এই ক্যান্টিনে পাবে। সেই ক্যান্টিনে কোন দোকানদার থাকবে না। স্কুলের বাচ্চারা তাদের নিজেদের সামগ্রীগুলো নিবে তার বিনিময়ে বাক্সে পেমেন্ট করবে। পণ্যের গায়ের মূল্য দেখে সে অনুযায়ী টাকা বাক্সে রাখবে। যাদের কাছে টাকা থাকবে না তারা ক্রেডিটে কিনবে। তারা তাদের চিটে পণ্যের নাম ইত্যাদি লিখে চিটের বাক্সে জমা করবে। মাস শেষে পেরেন্টস এর কাছে বিল যাবে। এই সততা ক্যান্টিনে অনেক লস হতে পারে। এই লস প্রতি মাসে জমতে থাকবে বছর শেষে এই লস গভর্নিং বোর্ডের মাধ্যমে সকল প্যারেন্টসকে ভাগ করে দেয়া হবে। প্যারেন্টসরা সততা ক্যান্টিনের উক্ত টাকা পরিশোধের বিষয়ে অবগত থাকবেন এবং অনুমোদন দিবেন। সততা ক্যান্টিন বাচ্চাদের উন্মুক্ত সামগ্রী মধ্যে রাখবে এবং তাদের লোভ সংবরণ করতে শিখবে। আমরা বক্তৃতায় অনেক বড় বড় কথা বলি বাচ্চাদের লেকচার দেই কিন্তু তাদের ট্রেনিং দেই না। এই ধরনের ব্যবহারিক ট্রেনিং বাচ্চাদের মূল্যবোধ পাল্টে দিবে। বাচ্চারা বুঝবে তারা সুযোগ থাকলেও কোন দ্রব্য সততা ক্যান্টিন থেকে নিবে না। একটা ফান টাইপ উক্তি আছে চরিত্র মানেই সুযোগের অভাবতাই আমরা শিশুকাল হতে সুযোগ দিতে পারি যেন ছাত্র/ছাত্রীরা বুঝতে পারে কিছু উন্মুক্ত কিছু পড়ে থাকলেও অনুমতি ছাড়া বা ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে না গেলে তা অপরাধ হবে। অন্যায় হবে। তাদের কেউ বাধা দিবে না কোন দ্রব্যাদি তুলে নিতে অথচ তারা দ্রব্যটির মূল্য পরিশোধ করে বা চিটে লিখে তবেই নিবে। এই ধরনের ক্যান্টিন শিশুদের নিজেদের লোভ হতে নিয়ন্ত্রণ করবে। পিতা মাতাসহ ও অভিভাবক সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে শিশুদের পিতামাতারা তাদের সন্তানরা সততা ক্যান্টিনে যেন ভুল করে কোন কিছু টাকা না দিয়ে বা মূল্য পরিশোধ করে নিয়ে না আসে এ বিষয়ে সন্তানদের বলবেন ও সচেতন থাকবেন।
সততা ক্যান্টিনে প্রতি মাসে মাসে অডিট হবে। অডিট হতে লাভ লস বের করা হবে। বছর শেষে সততা ক্যান্টিনের লাভ ক্যান্টিনে পূন:বিনিযোগ হবে। আর লস হলে সকল মাসেরটা যোগ করে মোট টাকা ছাত্র/ছাত্রীর কাছ থেকে গড়ে আদায় করে পরিশোধ করা হবে। সততা ক্যান্টিনের লসের টাকাটা পিতা মাতা ও অভিভাবকের কাছ থেকে আদায় করা হবে। বাংলাদেশের দুই একটি স্কুলে এ ধরনের ক্যান্টিন চালু থাকার কথা শুনেছি। এটা সারা দেশের সকল স্কুলের জন্য চালু করা যেতে পারে। এর জন্য স্কুল প্রতি কিছু টাকা সরকার শিক্ষার বরাদ্ধ হতে পূর্ণ করতে পারে। আবার অনেক সমাজ পতিরা তাদের এলাকার স্কুলে ও কলেজে চালু করতে পারেন। অন্যান্য অনেক স্কুল ও কলেজ ছাত্র/ছাত্রী ও পিতা মাতার সহায়তায় এটি চালু করতে পারে। সততা ক্যান্টিন বাস্তব ধর্মী সততা অনুশীলনের পরীক্ষাগার বিধায় বাংলাদেশের সকল স্কুল কলেজে চালুর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কারণ পিতামাতা যাই থাকুন তারা সব সময় চান তাদের ছেলে মেয়েরা সততার মধ্যে থাকুক।

Thursday, February 8, 2018

প্রবাসী নিয়োগ সামাজিক সমিতি

আদম ব্যাপারী ও দালালে দেশটা ভরে গেছে বিদেশে গমন ইচ্ছুক যুবক যুবতীদের দালালের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সামাজিকভাবে কিছু করতে পারি কয়েকটি গ্রামকে নিয়ে একটি স্থানীয় ভাবে অলাভজনক সমিতি তৈরি করা যায় সমাজের বিত্তবানরা সমিতি পরিচালনার জন্য আর্থিক সাহায্য দিতে পারেন সমিতি পরিচালনার জন্য বিদেশের অভিঞ্জতা সম্পন্ন সৎ দুই/একজন মানুষকে নিয়োগ দেয়া যায় সমিতিটি একটা অলাভজনক ভাবে ডোনার দ্বারা পরিচালিত হতে পারে সমিতির কাজ হল গ্রামের সহজ সরল যুবক যুবতীদের বিদেশ পাঠানোর নামে নিয়োজিত দালালদের কবল থেকে রক্ষা করা যুবক যুবতী যারা বিদেশে যেতে চায় তাদের দক্ষতা অনুযায়ী তথ্য যাচাইকরা দক্ষ দুই একজন ট্রাভেল এজেন্টের কাজ জানে এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রথমে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের তথ্যাদি নিতে হবে বাংলাদেশের সরকারের বিভিন্ন অফার ও প্রঞ্জাপন সর্বদা হালনাগাদ তথ্যাদি এই কেন্দ্র অবগত থাকবে
অধিকাংশ আদম ব্যাপারীদের দালালরা যা করে তারা নিয়মিত গ্রামে যায় যুবক/যুবতীদের উদ্বুদ্ধ করে দালাল যা যা টাকা খরচ হয় তার চেয়ে বেশী টাকা ফাঁকি দিয়ে নেয় এই‌  দালাল শ্রেণীটাকে সহজেই দুর করা যাবে এই  ধরনের প্রবাসী নিয়োগ সমিতির মাধ্যমে দালালরা যে কাজটা করে এই কাজটাই এই ধরনের অলাভজনক সমিতি করতে পারে
আমাদের দেশে প্রবাসে নিয়োগ নিয়ে এত এত সমস্যা তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না প্রবাসে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানেও আবার চলে বড় একটা বাণিজ্য মেডিক্যালটা করার জন্য প্রথমে তাদের ঢাকায় কেন্দ্রীয় একটা প্রতিষ্ঠানে আসতে হয় সেখান থেকে তারা রেজিস্ট্রি ঔই সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি মধ্য প্রাচ্যের রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পন্ন করে রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠান আবার বাংলাদেশের কয়েকটি তালিকাভুক্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাধ্যমে মেডিক্যাল সম্পন্ন করে থাকে এখানেও দালালরা একটা বাণিজ্য করে আর তা হল তারা ফিট ক্যান্ডিডেটকে বলে আপনি ফিট নাই টাকা দেন আপনাকে ফিট করব তখন টাকা নিয়ে ফিট লেখায় সাধারণত বাংলাদেশের অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান আনফিট প্রার্থীকে ফিট করে না এতে তাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে দালালরা এখানে ধোঁকা দিয়ে টাকা খায় প্লেনের টিকেটের ক্ষেত্রেও বেশী টাকা নেয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেবার গ্রহনকারী দেশ প্লেনের টিকেট ফ্রি দিয়ে থাকে এটা দালালরা গোপন করে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয় এই ধরনের অনিয়ম বা প্রতারণা করার সুযোগ দালালরা কেবলমাত্র তথ্য গোপন করেই করে থাকে অথচ বর্তমানে ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির যুগে এই ধরনের প্রতারণায় পরার কোন কারণ নেই এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা কয়েকজন শিক্ষিত সমাজ সেবক নিয়েই গ্রামেই রিক্রুটিং এজেন্সি করা যায় যার নাম আমি দিয়েছিপ্রবাসী নিয়োগ সামাজিক সমিতি”। এর মাধ্যমে এই অনিয়মগুলি দুর করা যায়
সমাজ সচেতন অনেক মানুষ স্কুল করেন মাদ্রাসা করেন ইত্যাদি অনেক প্রতিষ্ঠান করেন অনুগ্রহ করে সামর্থবানরাপ্রবাসী নিয়োগ সামাজিক সমিতিপ্রতি ইউনিয়নে বা উপজেলায় একটি করে স্থাপন করতে পারেন আপনি শুধু এতটুকু হিসাব করে দেখুন আপনার উপজেলায় যদি মাসে দশজন দেশের বাইরে যায় প্রত্যেকে যদি এক লক্ষ টাকার স্থলে তিন লক্ষ টাকায় বিদেশে যায় তবে এই সমিতির মাধ্যমে আপনি প্রত্যেকের দুই লক্ষ টাকার প্রতারণা ঠেকাতে পারবেন ফলে প্রতি মাসে গরীব মানুষের ২০ লক্ষ টাকা বেচে যাবে এই টাকাটায় গরীব পিতা মাতার কি পরিমাণ সাফারিং হত যারা গ্রামে মাঝে মাঝে যান তারাই কেবল জানতে পারবেন

আধুনিক ইন্টারনেটের সময়ে বিমান টিকেট পেতে, টিকেট কাটতে ঢাকায় আসতে হয় না -টিকেট কেটে প্রিন্ট করে নিলেই হল ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রামে বসেই টিকিটের পেমেন্ট করা যায় আজকাল অনেক উপজেলায় বিমান টিকেট কাটা যাচ্ছে অনেক জেলা অফিস থেকে হজ্বের যাবতীয় কাজ করা যাচ্ছে এখন ট্রাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সি ঢাকা বেইজ না হলেও চলবে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলার যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করা সম্ভব পরিশেষে বলব আমরা সচেতন নাগরিকরা আমাদের এলাকায় প্রবাসী নিয়োগ সমিতি বা অন্য নাম দিয়ে এজেন্সি করে দরিদ্র মানুষদের প্রতারণার হাত থেকে আমরা রক্ষা করতে পারি

Thursday, February 1, 2018

যুগে যুগে রাত জাগা

এই  যুগে আমরা ছেলে বুড়োরা রাত জাগি মোবাইল নিয়ে। আগেও কিন্তু আমরা রাত জাগতাম। সেটা লুকানো যাবে না। কারণ যুগে যুগে সবাই কম বেশী অননুউৎপাশীল কাজে রাত কাটিয়েছে। মাঝে মাঝে দস্যু বনহুর ও মাসুদ রানা পড়ে সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছি। ছোট রেডিও বা ট্রানজিস্টার যখন আসল তখন আবার বিদেশী রেডিও চ্যানেল শোনা নিয়ে রাত জাগা।  মাঝে মাঝে  রেডিওতে টেস্ট ক্রিকেট  শুনতে থাকা। ইংল্যান্ডে খেলা হলে রেডিও শুনেই রাত জাগা।  টিভি যখন আসল তখন রাত ১২ টা পর্যন্ত দেখা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল। মাঝে সাদা কালো টিভিতে রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখতাম। অনেক সময় টুয়েন্টি নাইন কার্ড খেলে রাত পার। ভিসিআরের আগমনে হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে রাত পার। অনেক টিভি চ্যানেল আসল। চ্যানেল বদলী করতে করতে রাত পার হল। আসল ভিসিপি ও ডিভিডি। ভিসিআরের পর পরিষ্কার ঝকঝকে ছবি দেখতে কত আনন্দ। ছবি দেখতে দেখতে রাত পার। এর পর আসল ইন্টারনেট। ভাল মন্দ ব্রাউজ করতে করতে পুনরায় রাত পার।
এক সময় আসল ইয়াহু চ্যাট। এটাও অনেক রাত পার করে দিত। মোবাইল কোম্পানী ঘোষণা দিল রাতে প্রায় ফ্রি বা কম পয়সায় কথা। শুরু হল বন্ধু ও প্রেমিক/প্রেমিকার রাত জাগা। ইন্টারনেট ও ফোনে রাত জাগা চলতে চলতে চলে আসল স্মার্ট ফোন। কম্পিউটার ও ল্যাপটপের যাবতীয় কিছুই যেন এর মাধ্যমে করা যেতে লাগল। স্মার্ট ফোনের সাথে চ্যাটিং, ফেইস  বুক, ইউটিউব চলতে থাকল। আগে রাত রাগা হত। বসে শুয়ে টিভি দেখে। কম্পিউটারে রাত জাগা অবশ্য বিছানায় শুয়ে করা যেত না। ভয়াবহ ভাবে রাত জাগাটা এখন শুরৃ হল স্মার্ট ফোনের  মাধ্যমে। রাতে বিছনায় শুয়ে শুয়ে ফেইস বুক, চ্যাটিং, ব্রাউজিং, ইউটিউব ভিডিও চলছে। রাত কখন পার হচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দস্যু বনহুর ও মাসুদ রানা পড়তে পড়তে অনেক সময় যখন হুশ হল তখন হয়ত দেখা গেল রাত দুইটা বা তিনটা। আজ যখন স্ত্রী বলে, “ছেলেদের রুমে লাইট জ্বলছে। ঘুমাতে বলতখন আমার নিজের সময়টা মনে পড়ে। বাবা মা বলত, “রাত জাগছ কেন। ঘুমাও। সকালে উঠতে হবে স্কুলে যেতে হবেআজ একই ভাবে ছেলেদের বলি, “বাবা লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়। সকালে স্কুল আছেআমার মতই ছেলেরা উত্তর দেয়, “কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ছিআমি জানি। আমি ঘুমিয়ে পড়ব। তাদের কিছুক্ষণ শেষ হবে মাঝ রাতে। ক্যাডেট কলেজে পড়শোনারত থাকাকালে অনেক সময় অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে স্টোরি বুক পড়তাম।  কিন্তু সকালে উঠে পিটিতে যেতে হত। কোন মাফ নেই। আজ ছেলেদের রাত জাগা ও তাদের বয়সে আমার রাত জাগায় পার্থক্য হল আমাদের হাতে বই ছিল। তাদের হাতে আছে স্মার্ট ফোন, ট্যাব ও কম্পিউটার/ল্যাপটপ।
আমি চাকুরীর আগের সময়গুলোতে আমার সিনিয়ররা সব সময় বই পড়তে বলতেন। আরও বলতেন বিছানার পাশে বই রাখতে ও ঘুমানোর আগে বই পড়তে। ঘুম না আসলে বই পড়তে। কঠিন বই নিলে কিছুক্ষণ  পড়ার পরই ঘুম চলে আসত।

আজ আমাদের বিছানার পাশে বই নয় আছে স্মার্ট ফোন। এই ফোনে বইও পড়া যায়। আমাদের সকলের আবার একটি বই বা বুক অনেক বেশী প্রিয় আর তা হল ফেইসবুক। আমরা আগে ঘুম না আসলে বই খুলতামঘুম চলে আসত। আজ ফেইসবুক এরূপ নেশার খেলা। উল্টো ঘুমাতে যাওয়ার আগে কেউ যদি ভাবে একটু ফেইস বুকটা দেখে নেই। তখন  একটু আর একটু থাকে না। এ দৃশ্যটা আজ স্বাভাবিক। স্বামী ও স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে। দুইজনই স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কোন কিছু নিয়ে রাত জাগা আগেও অনেকের অভ্যাস ছিল। এখন প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে ভিন্ন আঙ্গিকে রাত জাগা চলছে। আমরা যেভাবে রাত জাগি না কেন এটা শরীরের জন্য ভাল নয়। এটাই বড় কথা। আমি আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগেই বেড রুম থেকে টিভি ও ডেস্কটপ কম্পিউটার বের করে দিয়েছি। কিন্তু মোবাইলটাকে বের করতে পারিনি। তবে আমরা স্বাস্থ্য সচেতনরা দুটি কাজ করতে পারিএক: মোবাইল ফোন রাতে বন্ধ রাখতে পারি। অপর কাজটি করতে পারি ফোনটি বিছানা থেকে দুরে রাখা। কারণ "স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল" এই বানী আজও অম্লান হয়েই আছে।