হয়তবা অনেক দিন আগে থেকেই বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে পাগল
ব্যতীত সকল মেয়ের বাবারা মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করে থাকে। আমি যেদিন দুই ছেলের পর যখন
এক মেয়ে আমাদের সংসারে আসল সেদিন আমার মেয়েকে নিয়ে আনন্দ হল। মনে পড়ল আমাদের প্রতি
আমার বড় বোনের অবদানের কথা। সে ছোটবেলায় আমাকে পড়িয়েছে। রান্না করে খাইয়েছে। আজ আব্বা
ও আম্মার বৃদ্ধ বয়সে তাদের নিয়মিত দেখভাল করছে। একটা পরিবারের মেয়ে বাবা ও মায়ের বৃদ্ধ
বয়সে ছায়ার মত পাশে দাড়াতে পারেন। তারই জীবন্ত উদাহরণ আমার বড় বোন। আমার দুই ছেলের
পর মনে আকুতি ছিল আমার বড় বোনের মত একজন কন্যা পাওয়া। যে কিনা বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দেখবে।
ছেলেদের কাছে এটা আশা করা যায় না। কারণ আমার জীবন থেকে দেখেছি। আমি চাকুরীর সুবাদে
দূরে থাকার কারণে আমি মাঝে মাঝে টাকা পাঠানো, দূর থেকে এ্যাম্বুলেন্স ও ডাক্তারের ব্যবস্থা
করা ছাড়া অহরহ বাবা মায়ের পাশে গিয়ে খেদমত করতে পারিনি। অথচ আমার বড় বোন প্রায়শই ঢাকা
থেকে গ্রামে আসে ও বাবা/মার পাশে থাকছে।
অথচ আমার অন্য কোন ভাইদের তা করা সম্ভব হয় না। মেয়েদের উপর সর্বদা
পিতামাতার এজাতীয় নির্ভরশীলতা অনেক পরিবারেই একটা সহজাত বিষয়।
একারণে আমাদের দেশে পিতামাতারা বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ে সংসার ইত্যাদি
নিয়ে অনেক বেশী চিন্তা করেন। ছেলেদের বিষয়ে পিতামাতা তেমন একটা চিন্তা করেন না। কারণ
ছেলেরা লেবারী বা যেকোন কাজ করে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। মেয়েরা কিভাবে বাঁচবে এটা
নিয়ে তাই পিতা/মাতা যথেষ্ট টেনশনে থাকতে হয়। মেয়ের পাত্রস্থ করা আর পাত্র উপযুক্ত কিনা
এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ছেলেদের জন্য বিয়েটা তেমন একটা সমস্যা নয়। ছেলে বাজে মেয়ে
বিয়ে করলে ছেলের বাবা ছেলেকে বউ সমেত আলাদা করে দিলেই হল। মেয়েদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত
পাত্র না পেলে সমস্যা ও চিন্তায় থাকে পরিবার। কারণ মেয়েরা স্বামী সংসার ফেলে যেন তেন
ভাবে যেখানে সেখানে যেতে পারে না। সাধারণত তাকে নিকটাত্মীয়দের কাছেই ফেরত আসতে হয়।
এটাই বড় সমস্যা। যে কোন মেয়ের কর্মজীবীই স্বামীই পরকীয়া বাদ দিলেও অন্য নারীদের সাথে
বন্ধুত্বে জড়াতে পারে। এছাড়া পরিবারের জন্য সঞ্চয় না করে মেয়ের স্বামী নিজের বাবা মা
ভাই বোনদের জন্য খরচ করার মত সমস্যা করতে পারে। এতে মেয়ের সংসার হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বিবাহিত মেয়ের পরিবার হুমকির মুখে পড়লে পিতামাতা চিন্তায় পড়ে যায়।
একটি জীবন উপাখ্যান তুলে ধরছি। আমার এক নিকট আত্মীয় তার মেয়েকে
বিয়ে দিয়েছেন একজন মাস্টার্স পাশ ছেলের কাছে। ছেলে গ্রাম থেকে সদ্য পাশ করা বেকার।
ছেলেকে অনেক জায়গায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয় কারণ ছেলে সবকিছুতে থার্ডিভিশন প্রাপ্ত।
বেকার ছেলে চাকুরী খুঁজতে খুঁজতে স্ত্রীকে শশুর বাড়ী রেখে ছেলে জন্ম দিয়ে ফেলল।
এরপর তাকে ঢাকায় দোকানের ব্যবসা দেয়া হল। তাতে ফেল করে পরিবারের
অন্য সদস্যের আর্থিক অবস্থার বারোটা বাজিয়ে ফেলল। পড়ে তাকে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে
চাকুরী দেয়া হল। এখানেও লালবাতি জ্বালাল। এরপর যে গ্রামে সে ছিল সেই গ্রামে তাকে একটা
দোকান দিয়ে দেয়া হল। গ্রামে পাকা বাড়ী করে দেয়া হল। গ্রামে সে তার প্রতিবেশী আত্মীয়দের
সাথে বিবাদ করে মারামারি মামলার আসামী হয়ে উপজেলা শহরে সপরিবারে ভাড়া বাসায় উঠল। আদালতের
জামিন নিয়ে আদালতে নিয়মিত হাজিরায় থাকল। এরমধ্যে সন্তান সংখ্যা বেড়ে হয়ে গেল তিন। উপজেলা
শহরে পুনরায় শশুরের ও আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানদারী শুরু করল। দোকানের আয়
দিয়ে পেটে ভাতে চলতে লাগল। চার সন্তান জন্ম দিয়ে ফেলল। এর মধ্যে চার সন্তান বড় হতে থাকে। পড়ার খরচ বাড়তে থাকে। শশুর
তার পেনসন আর অন্য আয় থেকে নাতি নাতনীদের পড়ার খরচ, জামা কাপড়, বাড়ী ভাড়া ও দোকান
ভাড়া দিতে থাকেন। সবই চলছিল মোটামুটি। এর মধ্যে শশুর অসুস্থ হলে শুরু হয় মেয়ের উপর
আরেক বিপদ। স্বামীর সাথে সাথে পড়ুয়া ছেলেও চাপ সৃষ্টি করে মেয়ের বাবার কাছ থেকে টাকা
আনার জন্য। মেয়ে কান্না করতে করতে আসে আর অসুস্থ
বাবার কাছে যা পায় তাই ভিক্ষা নেয়। বদ স্বামী তার সন্তানদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে তাদের
মা তাদের নানা নানীর কাছ থেকে টাকা না আনলে তাদের উপায় নাই। মেয়ের অসুস্থ বাবা ও মা
যথাক্রমে ৮০ ও ৭৫ বছর বয়সে নিজেদের ঔষধ ও ভাল মন্দ খাবার না কিনে মেয়ের সংসার বাচাতে
তৎপর থাকতে হচ্ছে। এ ধরনের গল্প অন্য কোন পরিবারে আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু
এরা আমার নিকট আত্মীয় হওয়ায় এ ঘটনাগুলো পীড়া দেয়। আমার নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ কিভাবে
বিপদমুক্ত করা যায় তা এখন থেকেই চিন্তা করি।
আমাদের বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়েটা এত বেশী সেনেসিটভ যে বিয়ের পর
মেয়ের সমস্যা নিয়ে অনেক বাবাকে কাঁদতে দেখেছি।
এটার কারণ মূলত ইজ্জত। মেয়েদের যে কোন বিষয়ে পিতামাতা মনে করেন তাদের ইজ্জতের হানি
হয়েছে।
মেয়ে বিয়ে দিয়ে অশান্তিতে কাটাচ্ছে অনেক অনেক পিতা মাতা। তাহলে
সমাধান কি?
একটা সমাধান হল, কোন অবস্থায় যত শিক্ষিত পাত্রই হোক না কেন বেকার
পাত্রের কাছে বিয়ে দেয়া যাবে না। যৌতুক দেয়া যাবে না। যৌতুক বেকার পুরুষকে আরো অকর্মণ্য
করে। স্ত্রীকে যৌতুকের চাপ দিতে থাকে। ধীরে ধীরে সে অতি লোভে অমানুষ হয়ে যায়। প্রথম
থেকেই শর্ত সাপেক্ষে বিয়ে পরিহার করতে হবে। বিয়ে করলে চাকুরী দিব এটাও পরিহার করতে
হবে। যদি বেকার পাত্রের পরিবার চালানোর মত বাড়ী ভাড়া, জমির আয় বা এ ধরনের আয় থাকে তবে
বিবেচনায় আনা যাবে। উচ্চশিক্ষিত বেকারের কাছে তখনই বিয়ে দেয়া যায় যদি মেয়ের কোন ইনকাম
সোর্স থাকে বা মেয়ে চাকুরী করে।
মেয়ে বিয়ে দেয়ার আগে তাকে কর্মক্ষম বা রোজগার উপযোগী করাটা সবচেয়ে
নিরাপদ। এতে আর যাই হোক মেয়ের স্বামীর সাথে সংসার হল কি হল না সেই চিন্তাটা আর থাকে
না। তবে মাস্টার্স পাশ করে পরবর্তীতে চাকুরী জুগিয়ে পাত্র পেতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই
মেয়েদের বয়স হয়ে যেতে পারে ২৬ থেকে ৩০ বছর। আবার ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে
চাকুরী পেয়ে মেয়েদের বিয়ে করতে গিয়ে দেখা যায় খুব কম পাত্রই সমবয়সী বিয়ে করতে রাজি
হয়। তবে সমবয়সী বেকার পাত্রই তখন ভরসা। সমবয়সী বেকার পাত্রদের আবার এমন হয় হয়ত সারা
জীবনই মেয়েকেই চাকুরী করে স্বামী সন্তানকে
খাওয়াতে হয়। তবু ভাল এ ধরনের বেকার স্বামী নিয়ে চাকুরীজীবী মেয়েরা বাবা মার জন্য আর্থিকভাবে
নিন্মমানের জীবন যাপন করা ছাড়া তেমন সমস্যা করে না।
একটা মেয়েকে নিরাপদ করতে হলে তাকে কর্মজীবী করতে হবে । যদি মেয়েকে
কর্মজীবী করতে বেশী সময় প্রয়োজন হয়, তবে বিয়ে
দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোন অবস্থায়ই বেকার ছেলের কাছে নয়। বেকার ছেলের কাছে বিয়ে
দিতে হলে অবশ্যই মেয়েকে উপার্জনক্ষম বা চাকুরে করতে হবে। মেয়েকে পড়াশোনা অবস্থায়
বিয়ে দিলে তার জন্য বাড়ী ভাড়া, জমির আয়, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে
উপার্জনের ব্যাক আপ জরুরী। যেন যে কোন সময় স্বামীর সাথে ব্রেক আপ হলে সন্তানসহ ভদ্রচোতিত
ভাবে জীবন ধারণ করতে পারে। যদি তা না হয় এবং বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল না হয় তবে মেয়েকে
ছোটবেলা থেকেই টিউশনি ও স্কুলে খন্ডকালীন শিক্ষকতা বা ইত্যাদি যে কোন অর্থ উপার্জনকারী
কাজ ছাত্রী অবস্থায় শিখাতে হবে। এ ব্যবস্থা যদি কোন পিতা করতে না পারেন অবশ্যই মেয়েকে
উপার্জনক্ষম না করে বিয়ে দেয়া অনুচিত। আমাদের সব কিছুই সব সময় একই অংকের অনুরূপ হবে
তা নয়। অনেক ভিন্নতা থাকতে পারে। পরিশেষে আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের
নিজের পায়ে দাড় করানো ব্যবস্থা ছাড়া তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে আর কোন বিকল্প নেই।
মেয়েকে উপার্জনক্ষম করতে পারলেই পিতামাতা চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন। আমাদের চারিপার্শ্বের
সকল পিতামাতাকে সচেতন করাই হবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
No comments:
Post a Comment