Pages

Thursday, July 9, 2015

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সাদৃশ্যপূর্ন সাশ্রয়ী হাইব্রিড মাইক্রো-গ্রিড সিস্টেম

যেকোনো দেশ তার নাগরিকদের বিদ্যুতের মত বেসিক রাইট প্রদানে চেষ্টা করে। বাংলাদেশে এখনও হয়তবা ৩০-৩৫% শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। আমরা বিদ্যুৎ মুক্ত মানুষদের কিস্তিতে সোলার প্যানেল ধরিয়ে দিয়েছি। সোলার প্যানেলের মিটি মিটি আলোতে সবাই অপেক্ষায় থাকে কবে বিদ্যুৎ আসবে । স্বাভাবিকভাবে সোলার প্যানেলের বিদ্যুৎ কেরোসিন বাতিকে দূরীভূত করেছে। পরিচ্ছন্ন ধুয়া বিহীন ও উজ্জ্বল আলো গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতের নাগাল হয়েছে। তার পর সোলার ব্যবহার কারী মানুষের বাতির পর আগ্রহ বাড়ে টিভি দেখা। ফ্যান চালানো। তার পরের আগ্রহ ঘরে ঘরে লাইট থাকা। বাথরুমে লাইট থাকা। চাহিদা ক্রমেই বর্ধিত হতে থাকে। ব্যক্তিগত সোলার সিস্টেমের পর যে কারো আগ্রহ হবে এর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আরো একটি বড় আকারে যাওয়া। তখন চলে আসে মাইক্রো-গ্রিড সিস্টেম। এতে সামর্থবান গ্রাহকরা আরো একটু বেশী পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশের একটি সংস্থা ইডকল বিদ্যুৎ খাতে কম সুদে লোণ দিচ্ছে। এতে মাইক্রো ক্রেডিট প্রদানকারীরা উপকৃত হচ্ছে। যেমন: গ্রামীণ শক্তি তারা ইডকলের লোণের মাধ্যমে গ্রাহকদের ক্ষুদ্রঋণের আওতায় সোলার প্যানেল দিচ্ছে। প্রতিটি গ্রাহক সোলার লাইটের জন্য ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত সোলার প্যানেলের ক্ষমতা অনুযায়ী সোলার প্যানেলের কিস্তি দিচ্ছে। এ কিস্তি হয়তবা তিন বছর নাগাদ দিতে হচ্ছে। যদিও গ্রাহক সোলার প্যানেলের মালিক হচ্ছে তবুও গ্রাহকের কয়েক বছর পর পুনরায় ব্যাটারি কেনা। অন্যান্য যন্ত্রাংশের মেরামতের মত কর্মকাণ্ড চলমান থাকবে। সোলার হোম সিস্টেমে গ্রাহকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ ও ব্যবহারের মধ্যে সীমিত থাকছে। তাদের ব্যবহার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। ঝড় বৃষ্টির দিনে সোলার প্যানেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়। অপরদিকে যখন যত প্রয়োজন সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ বাড়ানো কমানো ও সেই সাথে প্রয়োজন মাফিক বিল দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে স্বাধীনতা অর্জন মাইক্রো-গ্রিডেই সম্ভব। মাইক্রো-গ্রিড সিস্টেম আর সাধারণ গ্রিড সিস্টেমের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। বরং হাইব্রিড সোলার মাইক্রো-গ্রিডে জেনারেটর যোগ করে সাধারণ গ্রিড সিস্টেম থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্রিড করা যায়। সোলার হোম সিস্টেমে সাধারণত বিদ্যুৎ ঘাটতি হয় আবার সিস্টেম প্রয়োজন অপেক্ষা বড় করলে কখনও কখনও বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে অপচয় হবে। অন্যথায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চাহিদায় ঘাটতি হবে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি গ্রামে গঞ্জে অত্যন্ত কম খরচে এলুমিনিয়ামের তার ও মিটার সংযোগ দিয়ে কয়েকটি লাইট, ফ্যান ও মোবাইল ফোন চার্জিং ইত্যাদি ব্যবহার করে সংযোগ দিচ্ছে। এতে হয়ত বা সর্ব সাকুলে মাসে ১০০/২০০ টাকা বিল আসে।
পল্লী বিদ্যুৎ এর এই ধরনের ভৌত কাঠামো তৈরি করে এখন পর্যন্ত যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ নাই সে সমস্ত গ্রামে অতি মূল্যবান বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া যায়। যেমন: একটি পরিবারে দুইটি ৭ ওয়াট এলইডি লাইটের সংযোগ (৭x২=১৪x৬ঘন্টা=৮৪ওয়াট)+দুইটি ডিসি ফ্যান(২০x২=৪০x১৫ ঘণ্টা =৬০০ ওয়াট, মোবাইল চার্জিং ১০ ওয়াট, ২১ ইঞ্চি এলইডি টিভি=২১x১০ ঘণ্টা =২১০ ওয়াট। তাহলে প্রতিদিন একটা পরিবারের ধরে নেই বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে ৮৪+৬০০+২১০=৮৯৪ ওয়াট বা এক কিলো ওয়াট। মাসে হবে ৩০ কিলোওয়াট।
এখন আমরা ২ লিটার ডিজেল ঘণ্টায় ব্যবহার করে এরূপ ৩০ কিলোওয়াটের জেনারেটর শ্যালো ইঞ্জিনে চালালে দৈনিক খরচ ২ লিটার x ২৪ ঘণ্টা x ৬৫ টাকা (প্রতি লিটার ডিজেলের দাম) =৩১২০ টাকা। আর তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা x২০কিলোওয়াট =৪৮০ কিলোওয়াট আওয়ার। তাই গ্রাহক প্রতি পনের থেকে বিশ টাকা ইউনিট নিতে পারলে মাইক্রো-গ্রিডের খরচ উঠে যাবে। স্বাভাবিকভাবে এটা শহরের বিদ্যুৎ এর প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু গ্রামের কয়েকটি লাইট ফ্যানের কাছে এ খরচ অনেক বেশী বলা যাবে না। এতে প্রায় নিশ্চিত হচ্ছে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ এর ব্যবহার। মাসে ৩০ কিলোওয়াট যাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার তাদের অনধিক ৪৫০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। এতে সে যা ব্যবহার করছে তা সোলার প্যানেলের লক্ষ টাকা খরচ করেও পারবে না। অথচ মাইক্রো-গ্রিড করে সকলে অত্যন্ত কম খরচে অনেক বেশী সুবিধা পাবে। মাইক্রো-গ্রিড যদি আমরা পল্লী বিদ্যুৎ এর মত পিলার, তার ও মিটার ব্যবহার করি তবে পুনরায় তেমন কোন খরচ না করেই পল্লী বিদ্যুৎ এর সাথে বা পিডিবি সিস্টেমে সংযোগ দেয়া যাবে। এতে গ্রাহকের ও সরকারের উভয় পক্ষের বিদ্যুৎ সংযোগ মিটার ব্যবহার ও সঞ্চালন লাইন টানায় নতুন করে খরচ করতে হবে না। শুধু মাত্র হাই ভোল্টেজ লাইন টেনে নিয়ে স্থানে স্থানে ট্রান্সফরমার দিয়ে বৈদ্যুতিক সিস্টেম চালু করলেই হবে। গ্রাহকের নতুন করে সংযোগ লাইন আর মিটার লাগানোর প্রয়োজন পড়বে না। পুরো ব্যবস্থাপনায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারেন। সিস্টেমটি সরকারীভাবে তৈরি করে এর পরিচালনা বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা চালু করা যেতে পারে।


আমরা এখন মাইক্রো-গ্রিডের সম্পূর্ণ বিষয়টি বোঝার জন্য একটি মডেল নিয়ে আলোচনা করব। আমরা একটি ৮ থেকে ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতার মাইক্রো-গ্রিড অফ-গ্রিড এলাকায় তৈরি করব। যে গ্রামটি বেছে নেয়া হয়েছে সে গ্রামটির বাড়ী ঘর একটি রাস্তার দুপাশে আড়াআড়ি ভাবে রয়েছে। যার দৈর্ঘ্য মনে করি অর্ধ কিলোমিটার। প্রতি ৫০ গজ দূরে দূরে ১০ টি ইলেকট্রিক পিলার স্থাপনে ৫০০ গজে খরচ ১ লক্ষ টাকা। বিতরণের জন্য মোটা এলুমিনিয়াম ৫০০ গজ তারে খরচ ৫০,০০০ টাকা। ৫ কয়েল প্রতি কয়েল দশ হাজার টাকা করে মূল্যমান। ৫০ বাড়ীতে লাইন টানতে ২০ গজ করে আনুমানিক ১০ কয়েল ৩০,০০০ টাকা। ৫০ টি বৈদ্যুতিক মিটার ৫০,০০০ টাকা। লেবার খরচ, যাতায়ত ও আনুষঙ্গিক খরচ ২০,০০০ টাকা। সর্বমোট খরচ ৩লক্ষ টাকা। শ্যালো ইন্জ্ঞিনের ৩০ কেভি জেনারেটরের মূল্য ১ লক্ষ টাকা , সোলার প্যানেল ৮,০০০x৫৫=৪.৪ লক্ষ টাকা( গ্রাহকের কাছ থেকে ৪০x৫০=২০০০ ওয়াট । সর্বমোট:১০ কিলো ওয়াট)। ব্যাটারি ১২ টি ১.২ লক্ষ টাকা। ইনভার্টর ও আনুষঙ্গিক ২ লক্ষ। সর্বমোট খরচ: ২.৫+১+৪.৪+১.২+২=১১.১ লক্ষ টাকা। অপরদিকে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার ন্যানো গ্রিড সিস্টেম ৩ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে  ৮ লক্ষ টাকায় সম্পন্ন করছে। তারা ব্যবহার করেছে স্পেশাল টাইপ আইটেম যা কিনা পরবর্তীতে পল্লী বিদ্যুৎ বা পিডিবি সাপ্লাই লাইনে ব্যবহার করা যাবে না। নতুন ভাবে সবকিছু কিনতে হবে। আর এখানে উল্লেখিত সিস্টেম সম্পূর্ণ ভাবেই পিডিবি বা পল্লী বিদ্যুৎ এর বিতরণ ব্যবস্থায় ধরনে তৈরি থাকবে। এতে ভৌত কাঠামোর কোন পরিবর্তন করতে হবে না। প্রয়োজনে পিডিবি বা পল্লী-বিদ্যুতের বিশেষজ্ঞ দ্বারা রাস্তার লোকেশন, জাতীয় গ্রিডের অবস্থান ও সাব জোনের অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় বিদ্যুৎ লাইন তৈরি করা হবে। একবার বিদ্যুৎ লাইনের ভৌত কাঠামো তৈরি করা গেলে তা যে কোন সরকারী/বেসরকারি সংস্থার কাছে ভাড়া দিয়ে সরকার কিছুটা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সোলার হোম সিস্টেম থেকে আরো অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ১কিলোওয়াট দৈনিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে ২৫০ ওয়াট প্যানেল, ১৫০ এএইচ এর দুইটি ব্যাটারি দিয়ে এককালীন খরচ প্রায় ৫০০০০ টাকার কাছাকাছি চলে আসবে। আর তিন বছরে সুদে আসলে ৮০০০০ টাকার কাছাকাছি সোলার বিক্রেতারা হিসাব করে বসবে। এটা কিস্তিতে দিয়ে তিন বছরের জন্য প্রতি মাসে আনুমানিক ২৩০০ টাকার কিস্তি দিতে হবে। তবে সুবিধা একটা আছে তা হল তিন বছর পর সোলার সিস্টেমটা নিজের হয়ে যাবে তখন আর কোন খরচ করতে হবে না। এটা তিন বছর ধরে ভালই চাপযুক্ত রাখবে। আর একই বিদ্যুৎ যদি মাসে ৪৫০ টাকায় প্রতিদিন এক কিলোওয়াট হিসাবে কেনা যায় তবে তা অনেক বেশী সাশ্রয়ী। কারণ ৮০,০০০ টাকা ব্যাংকে রাখলেও পরিবার সষ্ণয় হিসাবে পাওয়া যাবে ৮০০ টাকা। অথচ ১ কিলোওয়াট দৈনিক ব্যবহারে আমরা বিল দিব মাত্র ৪৫০ টাকা ৩৫০ টাকা সেভ ও ৮০,০০০ টাকা মূলধন খরচ করতে হল না। সোলার প্যানেলের দাম ৫৫/৬০ টাকা ওয়াট প্রতি খরচ চলে এসেছে। ব্যাটারির দামটা বেশী হলেও দীর্ঘস্থায়ী ও উন্নত ব্যাটারি বাজারে শীঘ্রই চলে আসবে। এসব পরিবর্তনের পর সোলার হোম সিস্টেম থেকে মাইক্রো-গ্রিড বা ন্যানো-গ্রিড লাভজনক হবে। সোলার হোম সিস্টেমে দুই/তিন দিন একটানা বর্ষা হলে সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ন্যানো বা মাইক্রো গ্রিড সিস্টেমে এ ধরনের কোন সমস্যা নেই। স্ট্যান্ড বাই জেনারেটর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ প্রবাহ চালু থাকবে। সোলার হোম সিস্টেম সেখানেই সফল হবে যেখানে এক কিলোমিটারের মধ্যে ২০ টির উপরে বাড়ী ঘর আছে। তা না থাকলেও ৩/৪টি বাড়ী একসাথে করেও গ্রিড সিস্টেম করা যাবে। সেক্ষেত্রে জেনারেটর হয়তবা ব্যবহার করা যাবে না। শুধুমাত্র সোলার ও ব্যাটারি ব্যাংকের সিস্টেম দিয়ে করতে হবে। আমরা অফ গ্রিড স্থানে সেলার হোম সিস্টেমের সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি একসাথে করে উন্নতমানের সোলার গ্রিড সিস্টেম চালু করতে পারি যা কিনা ভবিষ্যতের সাধারণ বিদ্যুৎ সংযোগের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে অত্যন্ত কার্যকরী হবে। এতে সাধারণ বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভৌত কাঠামো তৈরি হবে। এ ধরনের ভৌত কাঠামো তৈরিতে সরকারী ভাবে বিনিয়োগ হলে বিদ্যুতায়নে সরকার অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারবে। পরিশেষে আমরা আশা করছি আমাদের দেশ বিদ্যুতে ও সবুজ শক্তি ব্যবহারে অগ্রগামী হবে।

No comments:

Post a Comment