Pages

Thursday, August 20, 2015

বংশমূলের অকৃত্রিম টানে ফিরে চল গ্রামে

পৃথিবীর এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে নিজের গ্রাম, নিজের এলাকা, নিজের জেলা ও নিজের দেশ নিয়ে ভাবনা ও তা নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকাটা অনেকটাই অমূলক ভাবনা। সারাদেশ আমার দেশ। সারাটা পৃথিবী আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যে কাজ করুক তার বাইরে নিজ জাতি বা পূর্বসূরিদের ভাবনা না হওয়াটা অনেকটা স্বার্থপরতার সামিল। অর্থাৎ হৃদয়ে স্বজাতি ও দেশ হল মুল বিষয়। মা ও মাতৃভূমি তার প্রতি রয়েছে আমার চিরন্তন দুর্বলতা। ব্যক্তিগত আয় উন্নতির জন্য আমরা আত্মীয় পরিজন ত্যাগ করে নিজের এলাকা ত্যাগ করি। আমি মাঝে মাঝে আমার গ্রামের বাড়ী কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের চৌব্বাস গ্রামে যাই। একবার গ্রামে যাওয়ার পর আমার গ্রামের চাচাত ভাই আমাকে বলল, আমি কিভাবে গ্রামের মানুষকে ভুলে গেলাম। সে গ্রামে থেকে পাকা বাড়ী করেছে। টাইলস দিয়ে টয়লেট করেছে। মটর লাগিয়ে রানিং ওয়াটার করেছে। সুন্দর আসবাবপত্র দিয়ে গ্রামে নিজের আবাসটিকে সাজিয়ে নিয়েছে। কুমিল্লা শহরে বিটিসিএল অফিসে সে চাকুরীরত আর তার স্ত্রী গ্রামের একটা হাই স্কুলে মাস্টারি করে। কিছুদিন পূর্বে সে সিলেটে চাকুরী করে বেশ কিছুদিন হল সে কুমিল্লায় বদলী হয়ে এসেছে। এখন পৈত্রিক ভিটায় দালান করে স্থিত হয়েছে। আমি তাকে আমার জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরলাম। প্রথমত: আমি জন্মের পর হতে আমার পিতার গ্রামে আমরা ছিলাম না । পিতার চাকুরীর সুবাদে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে থেকে ঘুরে বেরিয়েছি। তাই ভাল লাগার জেলা আমার জন্য কুমিল্লা নয়। আবার বিয়ে করার সুবাদে ও জামাই আদর পাওয়ার সুবাদে বগুড়া থাকা খাওয়া ও অবস্থানের দিক দিয়ে মন্দ মনে হয়নি। এখন আমি কুষ্টিয়াতে চাকুরী করছি। কুষ্টিয়াও আবাসনের বিচারে মন্দ নয়। আবার বিদেশে অর্থাৎ আফ্রিকায় গিয়েছি। কঙ্গো ও সিয়েরালিওনের অবস্থা আবার আমাদের দেশের থেকে ভাল নয়। সেসব দেশে থেকে আন্তর্জাতিক বাসিন্দা হওয়ার মোটেই শখ নেই। আমাদের বাংলাদেশীরা যখন জীবিকা উপার্জনের জন্য বিদেশ যায় তখন তার পরিবার থাকে বাংলাদেশে। তাই উন্নত দেশের উন্নত পরিবেশ তার জীবনে তেমন একটা রেখাপাত করে না। যদি কখনও আমরা কোন দেশে স্বপরিবারে থাকি তবে সে দেশ আমাদের জীবনে যথেষ্ট রেখাপাত করে বৈকি। তাই কখন কোথায় মানুষ তার আবাসন গড়ে নিবে এটা চিন্তা করে বের করাটা দূরহ বিষয়। আমার কাজিন যে উপদেশ মুলক বক্তৃতা দিয়েছে তার জন্ম, পড়াশোনা ও চাকুরী নিদ্দিষ্ট এলাকা কেন্দ্রিক। তাই তার চাকুরী শেষে নিজেকে স্থিত হওয়ার স্থান নির্বাচন করাটা সহজ। আমার বাবা ও মা ছিল আত্মীয় চাচাত ভাই বোন। তাদের রুট এক জায়গায় হওয়ায় রিটায়ারমেন্টের পর আমার বাবার গ্রামে ফিরে যাওয়াটা জটিল কোন বিষয় হয়নি। আমি কুমিল্লার অরিজিন ও আমার স্ত্রী বগুড়ার অরিজিন হওয়ায় মাঝে মাঝে চিন্তা করি আমার সন্তানরা কোন দিকে যাবে। চাকুরীর কারণে আমি আগাগোড়াই কুমিল্লার গ্রাম থেকে বেশ দূরেই থাকছি। সন্তানদের জটিল যাতায়তের রাস্তা ও আরামদায়ক ভ্রমণ না হওয়ায় তেমন একটা গ্রামে নিতে পারিনি। হয়তবা যে খরচ করে গ্রামে নিয়ে যেতে হয় সেটা চাকুরীর নিয়মিত বেতন থেকে বের করা কষ্টকর। এর জন্য জমা টাকা ভাঙ্গতে হবে। তাই অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তৈল কিনে নিজ কারে বা ভাড়া করা গাড়ীতে প্রায় ৬০০ কি:মি: যাতায়াত করতে ইচ্ছে করে না। কেবলমাত্র বাবা ও মাকে দেখার দায়বদ্ধতা ছাড়া। অন্য দিকে আমার বড়বোন, বড়ভাই, ঢাকা থেকে প্রতিনিয়ত বাবা মাকে দেখতে বাড়ীতে যাচ্ছে। স্বল্প খরচে তাদের বেড়ানোর জায়গা হল গ্রামে গিয়ে বাবা মাকে দেখে আসা। আমার মেঝ বোন ও ছোট বোন কুমিল্লা শহরে ও নিকটবর্তী উপজেলায় থাকে বলে প্রতিনিয়ত তাদের দেখতে যাচ্ছে। চাকুরীজীবিদের জন্য দূরত্ব ও খরচ একটা বড় বিষয়। নিদ্দিষ্ট বেতনে যারা চাকুরী করে। তারা স্বীয় অবস্থানে থাকা, খাওয়া ও কাপড় চোপড়ের মান বজায় রাখতে নির্ধারিত বেতন অধিকাংশ চাকুরীজীবিরই টানা পোড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অভ্যাস আর একটা বিশাল বিষয়। আমি আজ যে জীবন ধারায় অভ্যস্ত সেটা গ্রামে পাওয়া যাবে কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একসময় দেশের প্রতি ভালবাসার কারণে নিজ এলাকার মানুষের প্রতি ভালবাসা উদ্বেলিত হত। এখন বাস্তবতা চিন্তা করলে মনে হয় ভৌগলিক সীমানার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। গ্লোবালাইজেশন প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে গ্রাম তো হিসাবেই নেইআমার কিছু বন্ধু বিভিন্ন দেশে চিরস্থায়ী ভাবে থাকার পরিকল্পনা করছে। কারণ তারা( স্বামী ও স্ত্রী ) ফিরতে চাইলেও উন্নত দেশের উন্নত সামাজিক নিরাপত্তায় ও ব্যবস্থায় সন্তানরা অনেক অভ্যস্ত হয়েছে। তারা দেশে বা নিজ এলাকায় পরিবার সহ বেড়ানো ব্যতীত ফেরত আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। দেশপ্রেম হয়তবা দেশে ফেরত এসে অবস্থান করে ভাল মন্দ কাজ করবে সে সংজ্ঞায় আমরা যেতে পারব না। অনেক চেষ্টা করলেও কুমিল্লার গ্রামে আমার সন্তানদের রাখতে পারব কিনা সন্দেহ। হয়তবা তাদের বেড়াতে নেয়া যেতে পারে। তাই জীবনের পরিকল্পনায় সন্তানদের দিয়ে গ্রামে থাকা হবে না। তবে গ্রামের নির্মল পরিবেশে স্ত্রী রাজি থাকলে সস্ত্রীক থাকা যায় । নতুবা জমির আয় রোজগার আনার জন্য ভবিষ্যতে গ্রামে যাওয়া আসা করা যাবে। তবে বছরে ১২ মাসের মধ্যে তিনমাস গ্রামে থাকলেও অনেক কিছু করার থাকবে। প্রথম কাজটা করতে হবে মিনিমাম নিজের স্ট্যান্ডার্টে গ্রামের বাসস্থানের রিনোভেশন করতে হবে। এখন গ্রামে থাকার জন্য রিনোভেশন অনেক অনেক সহজ কাজ। কারণ গ্রামেও মফ:সল শহরে ঢাকার সব নির্মাণ সামগ্রী পাওয়া যায়। রাস্তা ও যানবাহন চলাচলের অনেক উন্নতি হয়েছে। কুরিয়ার ও ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের বদৌলতে গ্রামে সুন্দর স্থাপনা করা সম্ভব। গ্রামে শহর থেকে কম খরচে সুন্দর স্থাপনা করা সম্ভব। আমাদের মত মধ্যম মানের চাকুরীজীবিদের জন্য বড় শহরে উন্নয়ন মূলক কাজ করাটা অনেক কঠিন। অনেক ধনীর ভিড়ে নিজের দানটুকু খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু গ্রামে একটা ছাত্রকে পড়ার খরচ দিলে ও একটা ল্যাপটপ বিতরণ করলে তা অন্যদের আশার আলো দিবে। গ্রামের লোকেরা তখন নিজেদের অনেক বেশি উজ্জীবিত মনে করবে। তারা আমাদের মত প্রবাসী বা দূরে অবস্থানকারীদের নিয়ে গর্ববোধ করবে। গত ২৮ এপ্রিল প্রথম আলোর খবরে দেখলাম সিলেটের একজন প্রবাসী ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি ব্রিজ তৈরি করেছেন। কারণ এ প্রবাসী জেনেছেন তার দাদীকে ব্রিজটি না থাকায় সময় মত হাসপাতালে নেয়া যায়নি। এতে তার দাদী মারা যায়। প্রবাসী যখন লন্ডনে যায় তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর। আজ অনেকদিন পর তার রক্তের সম্পর্কের শোধের একটা চেষ্টা করেছে । সে আবার ব্রিজ উদ্বোধনের উপলক্ষে ১৪ দিনের জন্য বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে। এটাকে আমরা দেখব যেখানেই থাকুক হৃদয়ে বাংলাদেশ হিসাবে। আমাদের দেশের অনেকের সন্তানেরা পড়াশোনার জন্য বিদেশে গিয়ে সেখানেই থাকতে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তারা কোন না কোন সময় তার পিতা ও মাতার দেশের মানুষের জন্য ভূমিকা রাখছে বা রাখার চেষ্টা করছে। অভ্যস্ততার জন্য বাংলাদেশে না থাকতে পারলেও সেই গ্লোবাল নাগরিকদের কাছে তার রুটের বা অরিজিনের জন্য কিছু করার জন্য আমরা অবশ্যই আশা করতে পারি।
আমি একজন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলাম যিনি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অনেক দেশ ঘোরেন। কিন্তু অবকাশ যাপনের জন্য রিসোর্ট টাইপ বাংলো বানিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। তার এ স্থাপনা সবার নজর কারে। আমি তার  এই উদ্দ্যোগে বেশ উৎসাহ দিয়েছিলাম। প্রথমত: গ্রামে মাঝে মাঝে এসে বেড়াব তারজন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করাটা তখনই যায় যখন কারো কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সারপ্লাস টাকা থাকে। এর জন্য যথেষ্ট অব্যবহৃত বাড়তি টাকা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে কয়েক কোটি টাকার আবাসন নিদ্দিষ্ট জায়গায় সীমিত পরিসরে বসবাস। আর গ্রামের অল্প মূল্যের জমিতে মনের খেয়াল খুশি মত সুন্দর একটা আবাসন তৈরি করলে মন্দ হয়না । বিশেষ করে শহর থেকে বেশী পরিমাণ গ্রীনারী পাওয়া যাবে। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার মত বিস্তৃত জায়গা পাওয়া যাবে। এ ধরনের আবাসন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর নামক ইউনিয়নে দেখেছি। সৌখিন মালিক তার এ গ্রামটি তার প্রবাসী কন্যা ও তার স্বামীকে উপরন্তু তার অনেক প্রবাসী বন্ধুবান্ধবকে যথেষ্ট আকর্ষিত করতে পেরেছেন। তারা মহা আনন্দে ফারুক সাহেবের গ্রামের সেই রিসোর্টে বেড়িয়ে যাচ্ছেন।
 গ্রামের থাকাটা আমাদের সকলের কাছে অত আনন্দের নয়। তবে আর্থিকভাবে সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যখন গ্রামে কিছু করে তখন তা আমাদের কাছে বিষয়গুলি বেশ ইতিবাচক মনে হয়। একজন ব্যক্তি তার মাকে স্মরণ করার জন্য গ্রামে যাওয়া। আর মায়ের কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন মসজিদ, হাফিজি মাদ্রাসা ইত্যাদি। আর গ্রামে যখন আসবেন তখন পরিবারের থাকার স্থানটি যদি আরামদায়ক ও আধুনিক হয় তবে গ্রামে গিয়ে যে কষ্টটা চিন্তায় আছে তা কিন্তু হয় না।
আমার বাবার কারণে আমার গ্রামে যাওয়াটা নতুন কোন বিষয় নয়। আমার বাবা ১৯৯১ সালে রিটায়মেন্টের পর গ্রামে চলে যান আর তখন থেকে গ্রামে আছেন আর বাবা ও মার টানে আমাদেরও যেতে হয় গ্রামে। বাবা গ্রামে না থাকলে আমরা গ্রামে যেতাম কিনা এটার বিষয়ে আমার কিছু সন্দেহ রয়েছে।

যদি সামর্থ্য হয় আমারও চিন্তায় আছে গ্রামে বেশ কিছু জনহৈতষী কার্যক্রম চালু করা। গ্রামে একাধিক বার যাওয়া আসা করা। পৈতৃক সম্পত্তি গুলো গুছিয়ে নিয়ে ইনকাম জেনারেটিং করা। একটা বেড়ানোর উপযোগী আবাসন তৈরি। তবে বিলাসিতা পূর্ণ নয়। কেবলমাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি থাকার স্থান। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায়ী জনাব ফারুকের সুরম্য বাসস্থান ও অন্যান্য স্থাপনা আমাকে “বংশমূলের অকৃত্রিম টানে ফিরে চল গ্রামে” এরূপ একটা অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অবসর যাওয়ার পরে সেই ইচ্ছা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রইলাম।

No comments:

Post a Comment