Pages

Thursday, September 3, 2015

ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার ও সামাজিক উন্নয়ন

আমি আগস্ট ২০১৫ এর প্রথম সপ্তাহে অনেকদিন পর আমার গ্রামে‌র বাড়ীত‌ে  বেড়াতে যাই। গ্রামে যাওয়ার পর আসে পাশে‌র এলাকা গুল‌োতে বেড়াতে  যাই। বেড়ানোর এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে কসবা উপজেলা, নয়নপুর বাজার, ক‌েল্লাপাথর, সালদা গ্যাস ফিল্ড ইত্যাদি। আমি সাধারণত বেড়ান‌োর  জন্য রিক্সা নিয়ে বে‌র হই। এটা  আমার দীর্ঘ  দিনের অভ্যাস। আমি য‌ে কোন নতুন স্থান‌ে আসল‌ে রিক্সায় উঠ‌ে ধীরে  ধীরে ঘুরত‌ে থাকি। আমারও  অনেক শহর বাসীর  মত এক/দুই বছর পর পর গ্রাম‌ে যাওয়া পড়ে। ঢাকা, কুমিল্লা ও বগুড়া এ তিনটি শহরে নিজ বাড়ী ও আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে প্রায়ই যাওয়া আসা করি। আমার পছন্দের কাজ হল অনেক দিন পর পর যেহেতু ছুটি আসি তাই অন্য গাড়ী বাদ দিয়ে রিক্সার মত ধীর যানে শহর ও পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনগুলো দেখতে দেখতে বেড়াতে থাকি। বাস থেকে নেমে সাধারণত রিক্সা নেই অনেক দূর হলেও তাই করি। শুধু পরিবর্তন ও উন্নয়ন গুলি দেখাই আমার রিক্সা সফরের উদ্দেশ্য। এই ধীর বাহনে  উঠ‌ে আমি  ভ্রমণরত স্থান‌‌ের  পরির্বতন গুল‌ো  বুঝত‌ে  বা অনুধাবন করত‌ে  চেষ্টা করি।
একদিন রিক্সা  নিয়ে গ্রামে‌র বাড়ী কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের দেউস গ্রাম হত‌ে  কসবা উপজেলা শহর দেখার জন্য ব‌‌ের  হই। যা কিনা আনুমানিক ১২ কি:মি দূরে। আমি যে রিক্সাতে  উঠেছি  সে‌ট‌ি মটর লাগান‌ো রিক্সা। আমি রিকশাওয়ালার কাছ‌ে জানত‌ে পারলাম।  রিক্সাটির  মালিকানা  তার। স‌ে বাইশ হাজার টাকা দিয়ে  রিক্সা কিনেছে। আর তা কিনেছে স্থানীয় সমবায় থেকে  ক্ষুদ্র  ঋণ  নিয়ে। আমি জানতে পারলাম রিক্সা ভাড়ায় নিলে দিনের জমা হয় ১৫০ টাকা। রিক্সার মালিককে যাবতীয় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করতে হবে। ১৫০ টাকা দৈনিক দিয়ে মাসে আয় ৪৫০০ টাকা হলেও মালিকদের রিক্সা ক্রয় করে তা পোষায় না। বর্তমানে গ্রাম এলাকায় রিক্সার মালিক শ্রেণী বিলুপ্ত হয়েছে। এটা দারিদ্র বিমোচনে অবশ্যই ভাল দিক। কারণ রিক্সা কেউ ভাড়া নিয়ে চালালে রিক্সার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া ছয়মাস পর পর ব্যাটারি বদল করে মোটরের রিক্সা চালাতে হয়। তাই রিক্সা কিনে ভাড়ায় খাটালে মালিকদের রিক্সায় তেমন লাভ নেই। রিকশাওয়ালা জানাল যারাই রিক্সা চালাচ্ছে কেউই দৈনিক ভাড়া নিয়ে রিক্সা চালায় না। গ্রামে এটা একটা বড় পরিবর্তন। রিক্সা যারা বানায় সেসব দোকানে গিয়ে বললেই হল আমি রিক্সা কিস্তিতে কিনতে চাই। আর সাথে সাথে ক্ষুদ্র ঋণের এনজিওরা এসে হাজির। তারা তিন/ চার হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা সাপ্তাহিক কিস্তিতে রিক্সা কিনে দিচ্ছে। সাধারণত ছয় মাস হতে এক বছর কিস্তি দিলে রিক্সার মালিক হয়ে যাচ্ছে। যে টাকায় মালিকের ভাড়ায় রিক্সা চালাত সেই জমার টাকায় মোটর রিক্সা হয়ে যাচ্ছে। এরই ফলে কিছুদিন আগেও রিক্সা কিনে ভাড়া দিলেও এখন গ্রামাঞ্চলে কাউকে রিক্সা কিনে ভাড়া দিতে তেমন একটা দেখা যায় না। সময় পাল্টিয়েছে। এখন জমা টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় রিক্সা না চালিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তির মাধ্যমে মালিকানায় রিক্সা চালাচ্ছে আধুনিক রিক্সা চালকরা। এটা একটা বিশাল পরিবর্তন। গ্রামে আবার ক্ষুদ্র ঋণের তেমন সমস্যা নয়। এনজিও এর মাঠ কর্মীরা বাড়ী বাড়ী গিয়ে ঋণ দিয়ে আসে। গ্রামে সকলেরই বলা যায় জমি আছে ঘর আছে। যাদের জমি নাই তাদেরও দেখা যায় নদীর পাড়ে খালের পাড়ে রেল রাস্তার ধারে খাস মালিকানার জায়গায় ঘর আছে। যাদেরই স্থায়ী ঘর আছে বা স্থায়ী ঠিকানা আছে তারাই এনজিওদের ভিআইপি কাস্টমার। গ্রামের মানুষের বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণের প্রাপ্তির অভাব নাই। শুধু মাত্র ঋণ পরিশোধে অভাব রয়েছে। শুধু মুখে ইচ্ছে করলেই হল। কাগজ নিয়ে লোক হাজির। টিপসই দিয়ে ঋণের টাকা নগদে প্রদান করে যাচ্ছে। একই ভাবে সপ্তাহ শেষ বা মাস শেষে কিস্তির টাকা নেয়ার জন্য দরজায় মাঠ কর্মী নগদে টাকা নেয়ার জন্য হাজিরচমৎকার হোম সার্ভিস। নি:সন্দেহে ইনকাম জেনারেটিং এ এই ক্ষুদ্র ঋণ অনেক অনেক বেশী ভূমিকা রাখছে। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে দূ:খজনক অধ্যায়ও রয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ও আত্মহত্যার মত অনেক ঘটনাও রয়েছে।

এই ক্ষুদ্র ঋণ সহজলভ্য হলেও এটা রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কোন অপশন নাই। ক্ষুদ্র ঋণে ধরা খেলে জীবন শেষ। আমার আলোচিত রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম সে যদি এ রিক্সা নিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়, তবে সে কিভাবে এ ঋণ পরিশোধ করবে। তার সহজ স্বাভাবিক উত্তর আল্লাহ দেখবেন। সে দূর্ঘটনার বিষয়ে ভাবতে নারাজ। যখন ঘটে তখন দেখা যাবে। দুর্ঘটনায় কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে এনজিও তার রিক্সা নিয়ে নিবে এবং অন্য কারো কাছে বিক্রয় করে দিবে। তার দেয়া সর্বমোট পরিশোধিত টাকা তার লস হবে। কত সহজ সমাধান। দুর্ঘটনা পরবর্তীতে সুস্থতা সাপেক্ষে পুনরায় কিস্তি নিয়ে রিক্সা ক্রয় করবে। জীবন পুনরায় চলমান হবে। জীবনের এত সহজ হিসাব ভাবতে সত্যি ভাল লাগে। রিকশাওয়ালাদের সমাধান সহজ হলেও আমরা সচেতন মানুষ এ সহজ সমাধান মেনে নেয়া উচিত নয়। এনজিওদের উচিত থার্ড পার্টি বীমা কোম্পানির সাহায্যে কিস্তি গ্রহণকারী ঝুঁকিপূর্ণ পেশার লোকদের বীমা করানো। যাতে পরিশ্রমী মানুষগুলোর জীবন দুর্ঘটনায়ও উত্তরণের সংগ্রামটি সহজ ও স্বাভাবিক হয়। ক্ষুদ্র ঋণ যথাযথ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট করে ব্যবহার করতে পারলে এই ঋণে মানুষের র্দূগতি কমে সুদিন আসবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম

No comments:

Post a Comment