আমার মাথায় সব সময়
একটা ঘড়ি চলতে থাকে। হাতে আমি ঘড়ি পড়ি না। কিন্তু মাথার এ ঘড়িটা বড়ই যাতনা করে।
একদম ছোট থেকেই আমার এ অভ্যাসটা আমাকে মানুষিক যাতনা দিচ্ছে। অভ্যাসটা হল যদি লেট
হয়। আমার এ অভ্যাসটা চাকুরীর এ বয়সে মোটেই শোভনীয় নয়। দীর্ঘ ২৫ বছর চাকুরীতে অনেক
হিসাব কিতাবের উর্ধ্বে চলে এসেছি। কারণ এখন চাকুরীতে হারানোরও কিছু নেই পাওয়ারও
কিছু নেই। তবুও একটা অভ্যাস। সেটা হল কোথাও যেতে হলে অনেক আগে প্রস্তুত হয়ে বসে
থাকা আর তা হল। “যদি লেট হয়”, যদি লেট হয় আমার কারণে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও সংক্রামিত
হয়েছে। একদিন আমার স্ত্রী একটা প্রোগ্রামে ১১টায় যাবে। আমি ১০টায় তাকে তাড়া দিচ্ছি
এই রেডি হচ্ছ না কেন। আমার স্ত্রী স্বাভাবিকভাবেই রেগে আগুন। আমার সময় হলেই আমি
রেডি হব। যেহেতু শাড়ী পড়ছি না আমার তাড়া নেই। তারপর তাকে দেখলাম যথা সময়ে হাজির
হতে। তবে আমার পরিবারের সদস্যরা ধীরে ধীরে আমার আবেশে আবিষ্ট হয়ে এখন কোথাও যাওয়ার
এক ঘণ্টা আগেই প্রস্তুত হয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে এমন হয় আমি নিজে কোন সমাবেশে
সবচেয়ে সিনিয়র, অথচ আমি নিজেই পাঁচ-দশ মিনিট আগে গিয়ে হাজির হচ্ছি। আমার
লেট হওয়ার অহেতুক টেনশনটা অত্যন্ত বিরক্তিকর।
আমি অফিসে যাওয়ার
জন্য আধঘণ্টা/একঘণ্টা আগে রেডি হয়ে বসে থাকি। বসে বসে টিভি দেখি নয়ত ক্লার্কদের
আসার আগেই অফিসে হাজির হয়ে ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়তে থাকি। অফিসে আগে এসে লাভ হয়
না। সাধারণত অনেক বস নিজের সময় মত আসেন আর নিজের সময় মত দেরি করে অফিস ছাড়েন। এতে
আমাকে যে বিপদে পড়তে হয় তা হল অভ্যাসগত ভাবে আগে অফিসে আসা আর অন্যের ইচ্ছায়
দেরীতে ফেরা। অফিস থেকে ফিরতেও আরেক বিপদ এখানেও ঘড়ির অফিস শেষের টাইমটা মাথায়
ঘুরতে থাকে। মাথার ভিতর হাতুড়ি পেটাতে থাকে টাইম শেষ, টাইম
শেষ। কিন্তু বসের তো আর টাইম শেষ হয় না। তাই লেট হওয়ার ভয়ে আগে আসা সময় শেষের পরে
যাওয়া একটা যাতনার সৃষ্টি করে।
“লেট যেন না হয়”
এ ধরনের মানসিক টেনশনে আরো কিছু কাজ আমার করতে হয়। সমস্ত পোশাক
পরিচ্ছদ পূর্বে সাজিয়ে রাখা। চশমা, মোবাইল, নোটবুক, ল্যাপটপ সব এক জায়গায় আগের রাতে গুছিয়ে
রাখা। এতে একটা আরাম হয়। সকলে রিলাক্স ও ফুরফুরে থাকা যায়। তার পর ঢিলা ঢালা ভাবে
রেডি হয়ে টাইমের আগে গন্তব্যে হাজির হওয়া যায়। আবার কোথাও গাড়ীতে গেলে আর এক
সমস্যা হয়। ড্রাইভারকে যেই টাইম দেই তার কমপক্ষে পাঁচ দশ মিনিট আগে আমার প্রস্তুত
হওয়া চাই। আমি প্রস্তুত না অথচ ড্রাইভার হাজির হয়েছে, এটা
আমাকে একটা অস্বস্থিতে ফেলে, অথচ তার কোন প্রয়োজন নেই। কর্তা ব্যক্তি হিসাবে
কর্তার জন্য চালক বসে অপেক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিকতাই আমি আমার
জন্য স্বস্থিদায়ক কখনোই করতে পারিনি। তাই ড্রাইভারের কাছে লেট হওয়ার চিন্তাটাও
প্রায়শই অদ্ভুতভাবে চাপ সৃষ্টি করে। আমার মত অদ্ভুত রোগে অনেকেই আক্রান্ত। তবে এতে
মাঝে মাঝে তাড়াহুড়ো বা হুরোহুরি না করার কারণে ধীর স্থির ভাবে সমস্ত কাজ করা যায়।
আগে থেকে কাপড় চোপড় সবকিছু গুছিয়ে রাখার মানসিক চাপ অনুভব করার কারণে পরে রিলাক্স
থাকা যায়।
একবার
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবিতে চাকুরীর সময় হুট হাট করে সীমান্তে রাত্রিযাপনের জন্য
যেতে হত। গরু চোরাকারবারীরা বিএসএফ এর গুলি খেত আর তা সামাল দিতে বর্ডারে যেতে হত।
প্রায়শই সীমান্তে রাত্রিযাপনের জন্য আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টার নোটিশে চলে যেতাম। তখন
একটা মানসিক চাপ কাজ করত। এই মানসিক চাপ কমানোর জন্য আমি একটা কাজ করলাম। আর তা হল
সর্বদা বাইরে যাওয়ার জন্য একটা ব্যাগ প্রস্তুত রাখা। এটা করার জন্য টুথপেষ্ট, টুথব্রাশ
ও অন্যান্য কাপড় আলাদাভাবে প্রস্তুত থাকত, এতে হঠাত করে রাত্রিযাপনের নির্দেশে
কখনোই আতংকিত হতাম না। এখনো কখনো বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে দুই একদিন আগে আমার
ব্যাগ গুছানো হয়ে যায়। যদিও ব্যাগ গুছাতে আধ ঘণ্টার বেশী লাগার প্রয়োজন নেই তবুও
গুছিয়ে ফেলি তার কারণ শেষ মুহূর্তে গুছাতে গিয়ে যদি লেইট হই। যদি কোন কিছু বাদ
পরে। শেষ মুহূর্তে যদি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথা সময়ে হাতের কাছে না পাই। ইত্যাদি
ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় ভাবনা।
আমি অন্যদের সাথে
তুলনা করে আমার এ ধরনের টেনশনের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে এ
টেনশনটাকে শক্তিতে রূপান্তর করে নিজে অনেক লাভবান হচ্ছি। আগে ভাগে প্রস্তুত থাকার
কারণে যে কোন কাজ নির্ঝন্জাটে করা যায়। এতে সময়ের ভাল ব্যবহার হয়। যেমন কোন একটা
কাজে যাব। কিছু আগেই পোশাক পরে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যে সময়টা হাতে থাকল তা
পত্রিকা পড়ে, টিভি দেখে বা কম্পিউটারে কাজ করা যায়। সময় হওয়ার আগে আগে
ধীরে ধীরে রওয়ানা দেয়া যায়। আমার মত যাদের “লেট হওয়ার টেনশন”
কাজ করে তারা আগে ভাগে রেডি হয়ে টেনশন দুর করে অন্য কোন উপকারী ও
রিলাক্স কাজ করে হাতে থাকা সময়টি কাটাতে পারেন। আরাম পাবেন। ইন্টারনেটে এক
মটিভেটরের একটা লেখা পড়ে ছিলাম। যদি অলসতা কাটাতে চান, প্রথম
কাজ হল জুতা পড়ে ফেলা। তাহলে আপনি যে কোন স্থানে যেতে প্রস্তুত। অলসতা কেটে যাবে।
বেশী রিলাক্স পোশাক পড়লে মানুষ বাসা থেকে কম বের হয় এবং বেশী মোটা হয়। তাই বাসা ও
বাইরে যাওয়া যায় এমন পোশাক মানুষকে বেশী সচল রাখে ও অতিরিক্ত ওজন ঝরাতে কার্যকরী।
এগুলো মূলত কিছু লোকের ভাবনার কথা। এগুলো কারো জন্য কার্যকর কিনা হলফ করে বলা যায়
না। “লেট হওয়ার ভয়” রোগটা সারাতে আরো
অনেকের অনেক পদ্ধতি থাকতে পারে। আমার পদ্ধতি সবাইকে জানালাম। অনেকের সাথে আমার
পদ্ধতি মিলে যেতে পারে। পরিশেষে বলব আমরা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে স্ট্রেস বা
টেনশন মুক্ত জীবন যাপন করার চেষ্টা করব। এতে আমরা আরো বেশী ভাল থাকব।
No comments:
Post a Comment