যুগ যুগ ধরে চলে আসা শরণার্থী
ক্যাম্প আমাদের পরিচিত একটি শব্দ। শরণার্থী বলতে আমরা যা বুঝি তা হল অন্য দেশ থেকে
অত্যাচারিত বা যুদ্ধে লিপ্ত দেশ হতে প্রতিবেশী দেশে নিরাপদ আশ্রয় নেয়া। ১৯৭২ সালে লক্ষ
লক্ষ বাংলাদেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদারদের হাত হতে বাচার জন্য। কুমিল্লার
ব্রাহ্মণ পাড়া উপজেলার চৌব্বাস নামক গ্রামে আমার দাদা ও নানা বাড়ী। আমার নানা স্কুল
মাস্টার ছিলেন। তিনি শরণার্থী হয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন সেখানে ডায়রিয়া হয়ে মারা যান। তার
মৃতদেহ শূন্য লাইন ক্রস করে বাংলাদেশে কবর দেয়া হয়। কারণ পাকিস্তানী আর্মির উপস্থিতির
কারণে আমার মামারা গ্রামে এনে কবর দিতে পারেনি।নানীর কাছে শরণার্থী শিবিরের তাঁবুর
জীবনের কষ্টকর গল্প শুনেছি। কিভাবে চাল আটা মিলিয়ে সিদ্ধ করে ঘাটি খেতেন। আর হাজারে
হাজারে লোক কলেরা বা ডাইরিয়ার মারা গিয়েছে। ভারতীয়রা অনেক সাহায্য করেছিল। পানি খেত
পুকুর থেকে ও নদী থেকে নিয়ে। সুপেয় পানির অভাবে তারা অনেকেই মারা গিয়েছিল। আশে পাশে
কুড়ানো কচু শাক, শুটকি ভর্তা ইত্যাদি খাবার ছিল তাদের নিত্য দিনের মেনু। প্রায় তিন
মাস শরণার্থী শিবিরে ডিসেম্বর মাসে তারা নিজের ভিটায় ফেরত আসতে পেরেছিল। অত্যন্ত করুন
ছিল সেই দিনগুলো।
আমাদের ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা
৩০ লক্ষ বাঙ্গালী হারিয়েছি। আমাদের প্রতিবেশী মায়ানমার বছরের পর বছর রোহিংগা নিধন করে
যাচ্ছে। আর রোহিংগারা বানের পানির মত বাংলাদেশে এসে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে।
কোন কোন রোহিংগারা আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে পাকাপোক্ত হয়ে
গেছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ব্যাপক হারে রোহিংগা বাংলাদেশে
ঢুকে পড়েছে। এই দুই বছরেই ৫ লক্ষ রোহিংগা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে
রয়েছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে রোহিংগা ছড়িয়ে আছে।
তেমনি অনেক অনেকে শরণার্থী ক্যাম্প ছড়িয়ে আছে
সারা পৃথিবী জুড়ে।
লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী
ক্যাম্পে আছে। শরণার্থীরা হয়ত অল্প কিছুদিনের জন্য থাকার কথা। কিন্তু মাসের পর মাস
তারা আটকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পে জন্ম হয় বড় হয়। বিয়ে করে। আবার বাচ্চা জন্ম হয়। সাইক্যাল
ঘুরতে থাকে আর সংখ্যা বাড়তে থাকে। অপুষ্টি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও মানবেতর জীবন নিয়ে তারা
ধুকে ধুকে বাচতে থাকে, এই আশায়, হয়ত কোন একদিন নিজের ভিটে মাটি ফেরত পাবে।
আমার মনে হল কেন আমরা “শরণার্থী
শিবির” বা “রিফিউজি ক্যাম্প” কেন মানব উন্নয়ন শিবির বা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প
বলি না।
রিফিউজিরা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত
হতে পারে। তারা প্রতিভা বিহীন নয়। তাদেরকে রিফিউজি ক্যাম্পের খয়রাতির উপর রাখা ঠিক
নয়। তাদের মাঝে যে ডাক্তার তাকে ডাক্তারি করাতে হবে। তাদের মাঝে যে টিচার সে বাচ্চাদের
পড়াবে। মিস্ত্রীরা ঘর বানাবে। মহিলা যারা ভাল রাঁধে তারা ক্যাম্পের খাবার রান্না করবে।
যারা দর্জির কাজ জানে তারা কাপড় বানাবে। যারা গাড়ী চালাতে জানে তারা গাড়ী চালাবে। শরণার্থীদের
যারা যেই কাজ জানে তাকে তার উপকরণ দিতে হবে। এমনকি যে ভাল ছবি আকে তাকে ছবি আকার উপকরণ
দিতে হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতার ছবি সে আঁকবে। অন্যরা তা কিনে নিবে। যারা কোন কাজে দক্ষতা
নেই তারা স্বাভাবিক মজুরী করবে। জমিতে কাজ করবে। এতে শরণার্থীরা আশ্রিত দেশের অর্থনীতিতে
নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে। তারা তাদের স্বস্থির জন্য তাদের আয়কৃত টাকা দিয়ে বিভিন্ন
দ্রব্য ক্রয় করতে পারবে। জাতিসংঘসহ যে কোন সাহায্য সংস্থা এই কাজগুলি করতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হল আশ্রিত দেশের
নিরাপত্তা কি এতে বিঘ্নিত হতে। এরা কি সাধারণ জনস্রোতে মিশে যাবে। এই আশংকা একদম উড়িয়ে
দেয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক যুগে এটা কোন সমস্যা নয়। শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক্স নিবন্ধন
করতে হবে। আধুনিক যুগের বায়োমেট্রিক্স সাধারণ ও সুবিধাজনক ব্যবস্থা। এটা করতে পারলে
প্রয়োজনে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সহজ হবে।
শরণার্থী কামাই বা রোজগার
করবে তার ভোগ্যপণ্য ও জীবন মানের উন্নয়নের পর তার কিছু টাকা বেচে থাকবে। তা রাষ্ট্রীয়
ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক একাউন্ট করে সঞ্চয় করানো
যাবে। শরণার্থী বিপদে/আপদে ও সন্তানের শিক্ষায় সেই টাকা খরচ করতে পারবে। যখন শরণার্থী
নিজ দেশে ফেরত যাবে তখন তার আশ্রিত দেশ সেই টাকা তাঁর দেশে পাঠাতে পারবে। এভাবে শরণার্থীদের
জন্য মানব উন্নয়ন শিবিরের মাধ্যমে কল্যাণ করা যায়। মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক
সাহায্য সংস্থাগুলি অনেক কাজ করেন। তারা শুধু তাদের কর্মপন্থা বদল করে শরণার্থীর জীবনধারণের
মোকাবেলাটা মানবীয় করতে পারবেন। তারা মানবীয় উন্নয়নগুলো করতে পারবেন। সকল মেয়েদের সেলাই
ও অন্যান্য অনেক কাজে দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া যায়। যাতে তারা যৌনকর্মীর মত ঘৃণ্য
পেশায় না যায়। আমার এই আইডিয়াটা নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আছেন তারা ভেবে দেখতে পারেন।
আমরা সাধারণ মানুষরা তাদের সেলাই মেশিন ও অন্যান্য আয় বর্ধক উপকরণ যাকাত হিসাবে প্রদান
করতে পারি। আমার এই ধারনা বা আইডিয়াটা যদি কারো মনে ধরে বা কোন সাহায্য সংস্থা তা বাস্তবায়ন
করে তবে আমার ভীষণ আনন্দ হবে।
No comments:
Post a Comment