Pages

Thursday, June 23, 2016

পরিবেশ বান্ধব ও কৃষক বান্ধব নয়া কৃষি

আমি আমার শৈশবে গ্রামে গেলে দেখতাম আমার কৃষক চাচা দুই তিনজন লোক নিয়ে জমিতে গরু দিয়ে হাল চাষ করছেন। জমিতে লোক নিয়ে ধানের চারা বা হালি লাগাতেন। ধান বীজটা ঘরে ছিল। যা ছোট জমিতে চাষ করে ধানের চারা করেছেন। নিজের ব্যবহারের পর কিছু অংশ অন্যদের কাছে বিক্রি করেছেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তেমন সার দিতেন না। পোকার জন্য অল্প কিছু বিষ ব্যবহার করতেন হয়তবা। কারণ এনড্রিন নামক বিষের নাম জানতাম। রাগ করে এনড্রিন খেয়ে গ্রামে অনেকেই আত্মহত্যা করত।বিষ তখন দেয়া শুরু হয়েছিল।
এখন পত্রিকায় দেখা যায় ধানের দাম কম ও কৃষকের মাথায় হাত। ফসলের উৎপাদন খরচ উঠে না তাই এ বিপদ। এখনকার কৃষিটা কেমন। আপনার ৫ বিঘা জমি আছে। আপনি ট্রাক্টর ওয়ালাকে ডেকে চাষ করার চুক্তি দিলেন। ৫ বিঘা জমি দুইদিনে চাষ করে দিল। আপনি তাকে বিঘা প্রতি ৬০০ দিয়ে ৩০০০ টাকা পরিশোধ করলেন।ধানের চারা ক্রয় ৫০০০ টাকা। ধান লাগানোর জন্য লোক নিলেন ১০ জন বা মেশিন দিয়ে লাগানোর চুক্তি দিলেন। ৩০০০ টাকা। পানি দেয়ার জন্য বিঘা প্রতি ২০০০ টাকা ১০০০০ টাকা দিলেন। সারের জন্য দিলেন আরো ৫০০০ টাকা। কীটনাশকের জন্য দিলেন আরো ৫০০০ টাকা। আগাছার পরিষ্কার কীট নাশক ছিটানো মনে করলাম আপনি করেছেন। ধার কাটা, মারাই ও পরিবহনের জন্য দিলেন আরো ৬০০০ টাকা। তবে আপনার খরচ কত পরল ৩৭০০০ টাকা। অর্থাৎ বিঘা প্রতি ৭০০০ টাকার মত। এ টাকা আপনি ক্ষুদ্র ঋণ পার্টি থকে ধার করেছেন। অথবা মহাজন থেকে সাপ্তাহিক সুদে নিয়েছেন। প্রতি বিঘায় আপনি ১৮/২০ মন ধান পেলে আপনি দাম ভাল থাকলে বিঘা প্রতি আপনি পেতে পারেন ৮০০০ হতে ১০০০০ টাকা। বিঘা প্রতি তিনমাসের ধান উৎপাদনে আপনার রিটার্ন হল ২০০০ হতে ৩০০০ টাকা আর ৫ বিঘায় তিনমাসে প্রাপ্তি ১০০০০ হতে ১৫০০০ টাকা। এ টাকায় কৃষকের সংসার চলবে না।
এখন আমি একটা মডেল তুলে ধরছি। বর্তমানে গরু দিয়ে চাষ করুক না করুক সব কৃষকের একাধিক গরু আছে। যদি কৃষক নিজের গরু দিয়ে চাষ করে তবে তার খরচ শূন্য। নিজের ঘরের ধান দিয়ে চারা করলে তার খরচ শূন্য গত বছরের নিজের ধান হতে। নিজের পরিবারের সদস্য দিয়ে চারা লাগালে খরচ শূন্য। রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার বা ঘরে তৈরি কেঁচো সার ব্যবহার করলে খরচ শূন্য। পানি তোলার জন্য ঢেঁকি পাম্প, খাল বা পুকুর হতে দোল দিয়ে তুললে সেচ খরচ শূন্য।ফসল নিজের সদস্যরা কাটলে ও পায়ে চালিত মারাই মেশিনে মারাই করলে খরচ শূন্য। এখন যন্ত্রের সাহায্য না নিয়ে, কীটনাশক ব্যবহার না করে ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে উৎপাদন করায় মনে করি আপনার বিঘা প্রতি উৎপাদন কমে হল ১৫ মন(এটা কমার কথা নয়) তবে ৫ বিঘায় আপনার উৎপাদন হল ১৫ গুন ৫=৭৫ মন। বাজারে একদম কম দামে ৪০০ টাকা মন বিক্রি করেও আপনি পাচ্ছেন ৩০০০০ টাকা। তিন মাস ধান উৎপাদনে আপনার পরিবারের জন্য মাসে আসল ১০০০০ টাকা। আর যান্ত্রিক ও আধুনিক চাষাবাদে আপনি পেয়েছিলেন ৩০০০ টাকা আর অযান্ত্রিক ভাবে আপনি পেলেন বিঘা প্রতি ৫০০০ টাকা সবচেয়ে কমের বাজার বিবেচনা করে ও সবচেয়ে কম ফসলের উৎপাদন হিসাব করে।যান্ত্রিক ও রাসায়নিক কৃষককে যতটুকু বেশী দিচ্ছে তার চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বেশী করছে।
কৃষক এখন গরু দিয়ে চাষাবাদ জানে না। হাতে টানা সেচ বা ঢেঁকি পাম্প কৃষক ব্যবহার করছে না। কৃষকের কৃষি চলে গেছে অন্যদের হাতে।এতে কৃষকের আরাম হয়েছে ঠিকই কিন্তু আর্থিক দৈন্যতায় কৃষক নিমজ্জিত হয়েছে।
আমার এখনও মনে আছে ছোটবেলায় বছরে এক/দুইবার আমার মা আমাদের নিয়ে গ্রামে যেতেন বর্গা ধান অর্ধেক ভাগ বিক্রি করার জন্য। এক সময় দেখলাম বর্গাদাররা বললেন স্কিমের টাকা দিতে। ডিজেল পাম্প দিয়ে জমিতে সেচ দিচ্ছে। জমির জন্য কৃষকের হাতে টানা সেচ বন্ধ হল তার জন্য নগদ টাকা গোনা শুরু।বর্গাদাররা একসময় এসে পোষাতে না পেরে সেচের টাকার ভাগ জমির মালিক থেকে নেয়া শুরু করলেন। তারপর সারের দাম। রাসায়নিক বিষের দাম এবং আধুনিক চাষাবাদের নামে কৃষক পতিত হল ঋণ গ্রস্থদের তালিকায়। ধানের চাষ করা কৃষকরা লাভ হোক লস হোক ধানের চাষাবাদ চালু রেখেছে জমি ব্যবহার করা প্রয়োজন তাই। জমি ফেলে রাখলে ঘাস হয়ে পরে চাষাবাদ উপযোগী করতে খরচ বেড়ে যাবে।
আধুনিক যুগে কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে নিজেরা কৃষি উপকরণ কিনে যান্ত্রিক সামগ্রী ব্যবহার করে খরচ কমাতে পারে অথবা ছোট ছোট পর্যায়ে প্রান্তিক কৃষকরা ফিরে যেতে পারে নি:খরচায় আদি কৃষিতে।
এখন আমরা পারি আদি ও আধুনিক কৃষির সংমিশ্রণ ঘটাতে। কয়েকজন কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে ট্রাক্টর কিনে নিজেরা শিখে নিয়ে চাষ করবে। তেমনি ভাবে সমবায়ের মাধ্যমে প্ল্যানটার ও রাইপার বা হারবেস্টার ক্রয় করে নিজেরা চালাবে। নিজেরা সমবায়ের মাধ্যমে সোলার পাম্প বসাবে এতে ডিজেলের সেচ থেকে খরচ কম পড়বে। রাসায়নিক সারের বদলে কম্পোষ্ট ও কেঁচো সার ব্যবহার করবে। কীটনাশকের বদলে প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহার করবে।
ইন্টারনেটের অর্গানিক কৃষি আর কীটনাশক মুক্ত কৃষির একটা আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশে মিডিয়াতে কিছু কিছু আলোচনা হচ্ছে।সেদিন হঠাৎ করে একটা ওয়েবসাইট পেলাম নাম উবিনীগ আর তাদের আন্দোলন নয়া কৃষি
তাদের ওয়েবসাইট হল,
http://ubinig.org/index.php/nayakrishidetails/showAerticle/6/23/bangla

সেখান থেকে এই নয়া কৃষির দশ মূলমন্ত্র নীচে দেয়া হল:
নয়াকৃষি নীতি ১: বিষ ব্যবহার এখনই বন্ধ করতে হবে। সকল প্রকার কীটনাশকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা নয়াকৃষির প্রথম নীতি। এই ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।
নয়াকৃষি নীতি ২: কৃষকের হাতে, ঘরে ও মাঠে বীজ রাখতে হবে। বীজই নয়াকৃষির ধ্যান, বীজ রক্ষাই নয়াকৃষির পথ, বীজেই বিপ্লব।
নয়াকৃষি নীতি ৩: রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই শুরুতে জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ এবং ক্রমে ক্রমে মাটির সুস্থ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে বাইরের কোন সার ছাড়াই মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা নয়াকৃষির পথ।
নয়াকৃষি নীতি ৪: একাট্টা ফসল অর্থাৎ এক প্রজাতি বা এক জাতের ফসল নয়াকৃষি করে না। সবসময়ই মিশ্র ফসল ও শস্যাবর্তনে বাহারি ফসল চাষ করে এক একর থেকে হাজার একরের ফলন আদায় করা নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৫: আবাদি ও অনাবাদী জায়গার ব্যবস্থাপনা - অর্থাৎ আবাদি ফসল উৎপাদনের ধরণেই এমন করা যেন একই সঙ্গে জমিতে প্রচুর অনাবাদী ফসল ঘরে তুলে বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা, এমনকি অন্য দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৬: পানির সুরক্ষা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সেচের জন্য মাটির ওপরের পানির পরিমিত ব্যবহারই নয়াকৃষির নীতি। মাটির তলার পানি ধ্বংস করা ও আর্সেনিকে পরিবেশ বিষাক্ত ও স্বাস্থ্য নষ্ট করার বিরোধী নয়াকৃষি। বাংলাদেশ মিষ্টি পানিতে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ। পানির দাম তেল, দুধ এমনকি মদের চেয়েও বেশি। এই পানি নষ্ট করা ভয়ানক অপরাধ।
নয়াকৃষি নীতি ৭: নয়াকৃষি এক ফসলের হিশাব দিয়ে চাষাবাদের সামগ্রিক লাভালাভের হিশাব করে না। শুধু শস্য নয়-খড়, পাতা, খড়ি, মাছ, মুরগী, পশু-পাখি, জীব-অণুজীবসহ সবকিছু হিশাব করলেই লাভালাভ জানা যায়। একটি শস্যের পরিবর্তে কৃষকের খামারে সামগ্রিক ফলনের লাভালাভ এবং প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পুরো গ্রাম বা জনগোষ্ঠীর পরিবেশগত ও আর্থিক লাভের খতিয়ান করতে শেখা নয়াকৃষির প্রধান একটি নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৮: গরু-ছাগল, হাঁস মুরগীসহ সকল গৃহপালিত পশু-পাখি অর্থাৎ প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা ও নয়াকৃষির কৃষক হয়ে ওঠা নির্ভর করে। প্রাণ, প্রকৃতি আর নিজের ঘরের মধ্যে ব্যবধান মুছে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই গৃহস্থের সামগ্রিক সম্পদ দ্রুত ও নিশ্চিত ভাবে বাড়ানোর সাধনাই নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৯: জলের সঙ্গে চাষির পানির খবরাখবর নেয়া বা পানির খবরদারি করা নয়াকৃষির একটি প্রধান নীতি। যেন মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো যায়। জল ও ডাঙা উভয়ের বৈচিত্র্য নিয়েই নয়াকৃষি।
নয়াকৃষি নীতি ১০: গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে জীবিকার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও আয় উন্নতির সুযোগ বাড়ানো নয়াকৃষির নীতি। কৃষক পরিবারসহ নয়াকৃষি এলাকায় প্রত্যেকটি পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল ও বাজার ব্যবস্থার অধীনস্থ না হয়ে আর্থিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ উভয় ক্ষেত্রে সম্পদশালী করা নয়াকৃষির নীতি।

বাংলাদেশে নয়া কৃষির আন্দোলন সত্যিই আশাব্যঞ্জক। এটা বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের একটা টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগবে। এখন সময় এসেছে কৃষককে আধুনিক কৃষিতে না ফেলে পরিবেশ ও কৃষক বান্ধব কৃষিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

No comments:

Post a Comment