আমি লেখকদের সাথে কথা বললে প্রকাশক বই
ছাপাতে টাকা নিয়েছে কিনা তা জানতে চাই। যার বই আছে তাকেই প্রশ্নটা করি। যারা টাকা দিয়েছে
তারা লজ্জায় মেনে নেয় তারা টাকা দিয়েছে। যাদের বই প্রকাশকরা বিনা পয়সায় ছাপিয়েছে তাদের
ভাব বা গর্ব আলাদা। এমন ভাব প্রকাশকরা তাদের পা ধরে বসে থাকে। হায়রে লেখক। হায়রে প্রকাশক।
আমার প্রথম বই প্রকাশকের প্যাচে পড়ে টাকা খরচ করে ছাপিয়ে আমি সত্যি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করছি। আমি নিজের টাকায় বই না ছাপালে প্রকাশনা শিল্পের এই গ্রে এরিয়াগুলো জানতাম
না। টাকা খরচ করে বই ছাপানোর কারণে আমি বাংলাদেশের
জন্য নতুন প্রকাশনার ধারনা প্রবর্তন করতে পারছি।
আমি একজন লেখকের সাথে কথা বললাম। সে জানাল
তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশ পাওয়ার পর তা পুরস্কার
পেয়ে গেল। তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর প্রকাশকরা আর পত্রিকাওয়ালা তার পিছনে লাইনে
আছে। তিনি লিখে কুলাতে পারছেন না। ভয়ানক সফল লেখক। আর একজন লেখক পেলাম তিনি আমার ফেইস বুক পোস্টের মধ্যে এ্যাড দিলেন তার বইয়ের। মহা
বিরক্তিকর। তাকে ইনবক্স করে জানতে চাইলাম, আপনার বই বের করতে প্রকাশক কত নিল। তিনি
দম্ভের সাথে বললেন, কেন টাকা দিব। আমার লেখা যাচাই বাছাই করে নওরোজ কিতাবিস্থান বই
ছাপিয়েছে। যাদের রয়েছে যুগের পর যুগ অভিজ্ঞতা। তিনি তার লেখার উচ্চ মর্গতা নিয়ে কথা
বললেন। আর একজন আন্তরিক লেখক তার বইটা দেখালেন। তিনি জানালেন তার
ফেস বুক জনপ্রিয়তাকে কনসিডার করে প্রকাশক বিনে পয়সায় তার বইটি প্রকাশ করার জন্য
উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। যাদের বই প্রকাশকরা বিনে পয়সায় ছাপাচ্ছেন তারা স্বাভাবিক কারণে অত্যন্ত
উচুমার্গের লেখক ভাবতে থাকেন। অনেক গর্ব। তাদের সাথে কথা না বললে বিশ্বাস করা সত্যিই
কঠিন। অনেকটা সফল ক্রিকেটারের মত। সেঞ্চুরি করার করার পরের হাল হকিকত। প্রকাশককে টাকা
দিয়ে বই ছাপিয়েছে বলতে সবাই লজ্জা পায়। কেমন যেন অপরাধী অপরাধী মনে করে। আমি ব্যতিক্রম
। বড় গলায় বলছি। আমার সাহিত্যের মান ভাল না। প্রকাশক বিনে পয়সায় ছাপতে চায়নি তাই টাকা
দিয়ে বই ছাপিয়েছি।
এতে আমি লজ্জা পাচ্ছি না । কারণ লেখার
মান সবার সমান হবে না। বানান ভুল থাকবে। লেখনীতে সাহিত্য কম থাকবে। কিন্তু সাহিত্য
ভাষা যত কমই থাকুন না কেন। ভাল বিষয় বস্তু হৃদয়গ্রহিী হয়। এটা আমি বড় গলায় বলতে পারি।
আমার সেনা জীবনের নেতৃত্বের প্রথমে শিখেছি তোমার ভাষার প্রকাশটা হরে এরূপ, যেন তোমার
অধীনের মানুষগুলো বুঝতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি সেদিন থেকে আমি বাংলায় সাহিত্য হারিয়ে
ফেলেছি। ভাষা হয়ে গেছে সাদামাটা। সাহিত্যের রসাল ভাবটা অনুপস্থিত। সকলে যেন বুঝতে পারে
আমার উপস্থাপনা ও কথা, এমন ভাবেই আমি উপস্থাপনা করি। এভাবেই লিখতে অভ্যস্ত হচ্ছি। আমাকে
কয়েকজন বলল, আমি নাকি কঠিন কথা সহজ ভাবে বলি। এটার কারণ হল আমার কথায় সাহিত্য নাই।
সকল কথা কথ্য ভাষায় বলি ও লিখি। আমার সাহিত্য প্রকাশকদের চলবে না। এটা চলবে ফেইস বুক
আর ব্লগে। আর চলবে শিশু সাহিত্যে। সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে যোগ্যতা বা বাসনা আমার কোন
কালে ছিল না। আমার আগ্রহ ছিল কোনটা ভাল ও কোনটা মন্দ তা নিয়ে বলা বা লেখা। তাইতো
গল্প, উপন্যাস ও কবিতা লিখতে চেষ্টা করিনি। কারণ রোমান্টিকতা দিয়ে নায়িকার চুলের বর্ণনার
সাহিত্য, আমার জন্য বড়ই জটিল। সেজন্য স্ত্রীর কাছে আমি একজন চরম অরোমান্টিক মানুষ। তাই নন রোমান্টিক ও নন ফিকশন লেখা ছাড়া
উপায় নাই। বাংলা একাডেমীর মোটা মোটা দুই বাংলা ডিকশেনারী দেখে আর অভ্র সফটওয়্যার
ব্যবহার করে বানান ঠিক করি। আমি চার জন উন্নত ও ডিমান্ডিং লেখকের সাথে কথা বলে বুঝলাম
লেখাটা আমার কাজ নয়। পেমেন্টে আর কয়দিন বই প্রকাশ করব। ৪০ হাজার টাকায় ১০০০ বই ছাপালাম।
৫০০টি বই সৌজন্য কপি বিতরণ করলাম। ৪৩০টি বই বিক্রি করে খরচের টাকাটা পুরো তুলে ফেললাম। লাভের ৭০টি বই
ধীরে ধীরে বিক্রি করছি। এদিকে দ্বিতীয় বই রেডি। টাকাও রেডি। আমার সাপ্তাহিক আর্টিক্যাল যা লেখা আছে তা দিয়ে চার ফর্মার সাত
খণ্ড বই বের করা যাবে। আমি নিজের টাকায় বই বের করছি নিজে বিক্রি করছি। বিতরণ করছি।
প্রথম প্রথম বই বিক্রি করতে লজ্জা লাগত। এখন দেখলাম লজ্জা লাগছে না। কারণ উন্নত দেশে
প্রতিনিয়ত সেলফ পাবলিকেশন বাড়ছে ও জনপ্রিয় হচ্ছে। এতে লেখকের লাভ বেশী। প্রকাশক নামক
মধ্যসত্বভোগী নাই। ইউরোপ ও আমেরিকার সেলফ পাবলিশ লেখকরা আমাদের দেশের লেখকদের মত
মুখ লুকায় না। ওরা গর্বিত হয়। কারণ সে সেলফ পাবলিশ করছে ও বেশী টাকা কামাচ্ছে। প্রকাশক
নামের কেউ তার মেধা দ্বারা অর্জিত টাকায় ভাগ বসাচ্ছে না। প্রকাশক ১০০০ বই বিক্রি করে
যে টাকা দেয়, সেলফ পাবলিশ করে ১০০ বইয়ে লেখকরা
সেই টাকা তুলতে পারে। এতে লেখকদের লাভ বাড়ছে। লেখকরা একটু কষ্ট করে সময় বের
করে সেলফ পাবলিশে এগিয়ে আসছে। সেলফ পাবলিশ লেখকরা একেকজন একেকটা উদ্যোক্তা। শুধু মাত্র
লাভ বেশী থাকার কারণে আমাজনে সেলফ পাবলিশ লেখকের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। ই-বুক
আর "প্রিন্ট বুক অন ডিমান্ড" সেলফ পাবলিশ লেখকদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ
করে নন ফিকশন লেখকরা বেশী উপকৃত হচ্ছে। প্রক্রিয়াটি আর্থিক ভাবে লেখকদের লাভবান করছে।
তাই সেলফ পাবলিশ লজ্জার কিছু নাই। সেলফ পাবলিশ করেছি বলে আমার লেখার মান ভাল হল না।
এটা একটা ফানি বিষয়। আমার কাছে মনে হয় লেখার ভাষা ঠিক করার জন্য অনেক পেইড সম্পাদক
আছে।তাদের দিয়ে পেমেন্টে সাহিত্য সংযোজন সম্ভব। এটা অনেকটা হায়ার করা উপস্থাপক বা
প্রেজেন্টারের মত। তাই লেখার ভাষা ঠিক করার থেকেও বিষয় বস্তু বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমরা
অনেক সুন্দর গুছিয়ে কথা বলা বক্তার অন্তঃসার শূন্য বক্তব্য কিন্তু শুনি। আবার অনেক
গ্রামীণ টানে কথা বলা লোকের চমৎকার বিষয় বস্তুর উপস্থাপনাও শুনি। উন্নত লেখক আর অনুন্নত
লেখকদের আমরা মজা করে বলতে পারি "ব্রাহ্মণ
লেখক" আর "নমশূদ্র লেখক"। এ বিভাজনে আমি যেতে চাই না। "বই কথা বলবে, আমি
কেমন লেখক" এটাও মানতে পারি না। লক্ষ বইয়ের ভিতর আপনি মাইক না বাজালে আপনার বই
চলবে না। এটা বাস্তব কথা। যে যাই বলুন, বই একটা "পণ্য" বা প্রোডাক্ট। এটা
পণ্যের মতই বিক্রি করতে হবে। লজ্জার কারণ নাই।
নমশূদ্র লেখকদেরও লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ
নেই। আপনি নমশূদ্র লেখক হয়ে যদি অনেক পাঠক পান তবে দু:খ করার কিছু নাই। পাঠক যদি আপনি
বেশী তৈরি করতে পারেন তবেই আপনি সফল। আমি বলব, প্রকাশক বাদ দিন। পাঠক আর বইয়ের বিষয়
বস্তুর জোর থাকলে প্রকাশক লাগে না। যেমন: কোমড়ে জোর থাকলে প্রিয়ার জন্য গার্ড বসাতে
হয়না। তাই বিষয় বস্তু ভাল হলে ও আর আপনার উদ্যোক্তার মানসিকতা থাকলে প্রকাশক না হলেও
চলে। চাষি বাজারে চাষিরা যেভাবে ডাইরেক্ট নিজের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করে তেমনি আপনি
আপনার বইটি ডাইরক্টি বিক্রি করবেন। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, মার্কটোয়েন নিজের বই নিজে ছাপাতেন
ও বিক্রি করতেন। তিনি তার সময়কার সবচেয়ে ধনী ও সফল লেখক ছিলেন। আমাজন বেস্ট সেলারের
বেশীর ভাগ বইই এখন সেলফ পাবলিশড। আমি নিজে একজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ। আমার সাথে অনেক
সহায়তাকারী আছে। আমি মনে করি আমি নিজেই সেলফ পাবলিশিং এ বিপ্লব ঘটাতে পারব ইনশাল্লাহ।
সেদিন হয়ত বেশী দূরে নয় যেদিন সেলফ পাবলিশ
লেখকরা লজ্জায় মুখ লুকাবে না। বরং প্রকাশকের টাকা দিয়ে যারা বই ছাপিয়ে প্রকাশকের সো
কল সন্মানী বা "দয়া করে যা দেয়" তা নিয়ে চলছেন সে সমস্ত লেখকরা লজ্জা পাবে।
সেলফ পাবলিশ লেখকরা বলবে, দেখ! আমার টাকা আছে। আমি সেলফ পাবলিশ করেছি আমি অন্যের টাকায়
বই ছাপাই না। অন্যের দান খয়রাতে চলি না। নিজের টাকায় বই ছাপাই। নিজের প্রোডাক্ট নিজে
বিক্রি করি। আমি নিজে উদ্যোক্তা "নপুংসক" নই। এভাবেই আমি গোটা বাংলাদেশের
"ব্রাহ্মণ লেখক" আর "হরিজন লেখক"এর মধ্যে পার্থক্যটা কমাতে পারব।
সেলফ পাবলিশ বা "সপুংশক লেখক" এরূপ নতুন আইডিয়াতে যেতে পারব। আর বেশী দুরে
নয় যেদিন সেলফ পাবলিশ লেখকরা শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারকে বলবে" আই এম এ সেলফ
পাবলিশ রাইটার। আই এম আরনিং টেন লাক টাকা পার মান্থ হোয়াট এবাউট ইউ"।
পরিশেষে বলব পরনির্ভরতা পরিহার করে চলুন
লেখক হিসাবে আমরা আমাদের বই "সেলফ পাবলিশ" করি।
No comments:
Post a Comment