মানুষ যুগ যুগ ধরে
তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য খুঁজে বেড়ায় নানা ব্যবস্থা ও মাধ্যম। একটা সময় ছিল
চিঠি নিয়ে কবুতর পাঠানো হত। তারপর আসল রানার দৌড়ে চিঠি দিয়ে আসত। পোস্টাল সার্ভিস।
অত:পর কুরিয়ার। আজকের দিনে আমাদের বলতেই
হবে আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। আমরা মূহুর্তে আমাদের প্রিয়জনকে এসএমএস, ইন্টারনেটের
মাধ্যমে ম্যাসেজ ও ইমেইল পাঠাতে পারি। আর সর্বশেষ ড্রোনের মাধ্যমে উপহার
সামগ্রী পাঠাতে পারি।
আগে আমাদের অনেকে
পেন ফ্রেন্ড করত (১৯৮৫ সালেরও আগে)। বিভিন্ন পেন
ফ্রেন্ডের বইয়ে বা ম্যাগাজিনে দেশী বিদেশী পেন ফ্রেন্ডে আগ্রহীদের ঠিকানা
পাওয়া যেত। আবার কোন কোন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার ব্যক্তিগত বিঞ্জাপনে অনেক
কলমি বন্ধু হওয়ার আবেদন পাওয়া যেত। বিভিন্ন ঠিকানায় চিঠি দিতে দিতে হয়ত একজন দুইজনের উত্তর পাওয়া যেত। তারপর
নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হত। একটা চিঠি দেয়ার পর পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠি যাওয়া
আসার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হত। প্রতীক্ষায় কাটত দিনের পর দিন। তখন হয়ত যোগাযোগ হত মাসে দুই/তিনটি
চিঠির মাধ্যমে। মানুষ তাদের কথাগুলো জমিয়ে রেখে ধীরে ধীরে লিখত। লেখার হরফে
জমা হত মানুষের পুঞ্জিভূত অনুভূতি। চিঠি
লেখাটা ছিল একটি শিল্পকর্ম। রাত জেগে সময়
নিয়ে দিনের পর দিন এক একটি চিঠি লেখা হত। সেই চিঠি গুলোতে থাকত
মনের গভীরের অনুভূতি ও শৈল্পিক
ভাবে ভাব প্রকাশ। আমি আমার স্ত্রীকেও অনেক চিঠি লিখেছি। ক্যাডেট কলেজ থেকে বাবা
মাকেও অনেক চিঠি লিখতাম। তাদেরও অনেক চিঠি পেতাম। মাঝে মাঝে কিছু চিঠি পেতাম অনেক
অনেক হৃদয় স্পর্শী সেগুলো অনেকবার পড়তাম।
প্রেম আর চিঠি তখন
বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজ মোবাইল ফোন প্রেমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মাধ্যম। অনেকের সাথে
যোগাযোগের জন্য ফেসবুক অন্যতম। আগে কলমের কালির ছোঁয়ায় জেগে উঠত অনুভূতি গুলো। আর
আজ মোবাইল ফোনের টাচ কীতে তা জেগে উঠে এসএমএস আর ফেইসবুকে। অনুভূতি বদলায়নি।
প্রকাশভঙ্গীর ধরন পাল্টেছে। ভাষা গুলো হয়েছে সংক্ষিপ্ত ।
আগে কারো সাথে প্রেমে ব্রেক করলে চিঠি গুলি ফেরত পাওয়ার
জন্য উদগ্রীব হতে হত। এখন এ অবস্থায় আমাদের ডিলিট আর রিমুভ নিয়ে ব্যস্ত হতে হয়।
সম্পর্ক ব্রেক করলে একসাথে তোলা সেলফি, ভিডিও ইত্যাদি সরানোতে
ব্যস্ত হয়। অন্যথায় প্রতিশোধ পরায়ণ প্রেমিক বা প্রেমিকাটি প্রমাণাদি নিয়ে ঝামেলা
করতে পারে। আগের দিনে প্রেমিক ও প্রেমিকাদের জমানো চিঠিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
গোপনীয় ও বিপদজনক ছিল। কারো হাতে পড়লেই লজ্জাজনক ও বদনাম হওয়ার ভয়
ছিল। আমরা কি এখন চাইলেই কারো সাথে চিঠি পত্রালাপ করতে পারব। মনে হয় পারব না। কারণ
আমি এখন কাউকে চিঠি লিখলে সে কষ্ট করে চিঠি লিখে উত্তর না দিয়ে মোবাইল ফোনে আমার
চিঠির জবাব দিবে। আর একান্তই মুখে বলতে না পারলে এসএমএস করে উত্তর দিবে। এখন হয়ত
বাবা মা’রা দুরে অবস্থান কারী সন্তানদের সাথে ফোনেই বেশী কথা বলে। যদি তাদের ফোনে
না পায় তবে দেয় ইলেক্ট্রনিক চিঠি, ক্ষুদে বার্তা অর্থাৎ
এসএমএস। এতে আধুনিক সন্তানরা অনেক সময় রেসপন্স করে। আবার কখনো করে না। ক্যাডেট
কলেজে থাকতে বাবার বড় বড় উপদেশমূলক চিঠি পেতাম। একবার আমাদের একজন শিক্ষক বলেছিলেন
তোমাদের বাবাদের লেখা চিঠি সংরক্ষণ করে রাখ। যেদিন তোমাদের ছেলে মেয়েরা হোস্টেলে
যাবে তখন তাদের যে চিঠি লিখবে সেদিন তোমাদের বাবার চিঠিগুলো মিলিয়ে দেখো। তখন
তোমরা দেখবে একই কথাই তোমরা লিখছ। অথচ মজার ব্যাপার হল প্রযুক্তির এতই উন্নতি
হচ্ছে যে আমরা ভবিষ্যতে আমাদের হোস্টেল পড়ুয়া ছেলে ও মেয়েদের কাছে আমাদের আর চিঠি
লেখার সুযোগই থাকছে না। এখন আছে এসএমএস, বেশী ইচ্ছে করলে
ইমেইলের মাধ্যমে চিঠি লেখা হতে পারে। অন্যথায় মোবাইল ফোনে কথা বলেই যোগাযোগ
সম্পূর্ণ হয়। এটার ভাল ও মন্দ দিক কি?আমার কাছে মনে হয় ভাল
দিকই বেশী। মন্দ দিক কম। একেকটার আনন্দ একেক রকম। যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলি আগে থেকে
আরো শক্তিশালী হয়েছে। অত্যন্ত সুলভ হয়েছে। চিঠির যুগে মনে করুন প্রেমিক প্রেমিকার
খবর জানতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হত। এখন যখন তখন এসএমএস। আরও ত্বরিত হল
মোবাইল ফোনে কল। সাথে সাথে যোগাযোগ। প্রেমিক ও প্রেমিকার সাথে কথা বলায় লজ্জা
পাওয়ার কিছু নেই ও লুকোচুরির কিছু নেই। যেকোনো স্থানে মোবাইল সাথে থাকলেই হল।
এসএমএস, ফেইসবুক,ইমেইল ও ভিডিও কল সবই
পকেটে। যোগাযোগ সেন্টার পকেটে। এখন প্রেমিকা হরিয়ে যেতে পারে মোবাইল ফোন হারালে।
কারণ প্রেমিকার মোবাইল ফোন নম্বর মুখস্থ থাকে না বা ডাইরিতে এখন লেখা হয় না। সেইভ
থাকে মোবাইল ফোনে। এটাও দূর হয়েছে। মোবাইল ফোন কোম্পানি এখন মোবাইল ফোন নম্বর
ব্যাক আপ রাখারও সলিউশন দিয়েছে। তাই নম্বর বদল না হলে প্রেমিক ও প্রেমিকা হারিয়ে
যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আগের সিনেমা গল্পে দেখি ভিলেন চিঠি আটকিয়ে দিয়েছে। এতেই
প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন। এখন মোবাইলের যুগে হারিয়ে যাওয়াটা এত সহজ
নয়। তেমনি পরকীয়া ও প্রতারণাও সহজ হয়ে গেছে। মোবাইল ফোনে অযাচিত সম্পর্ক বেড়ে
যাচ্ছে। পারিবারিক সম্পর্কে ফাটলও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিঠির যুগে সম্পর্ক হত ধীরে
ধীরে। এতে সম্পর্ক টেকসই হত বেশী। এখন সম্পর্ক হয় দ্রুত। মনে করি প্রতি রাতে
প্রেমিক প্রেমিকা যদি দুই ঘণ্টা করে কথা বলে তবে মাসে বলবে ২ x ৩০ বা ষাট ঘণ্টা। ৬০ ঘণ্টা প্রেমিক প্রেমিকা আলোচনা করলে নিজেদের অনেক কিছুই
একমাসেই জানা হয়ে যায় । আর চিঠির যুগে একমাসে দুই/তিনটি চিঠিতে যা যোগাযোগ ঘটত
তাতে ভাব ও তথ্যের আদান প্রদান হত মোবাইল ফোন হতে অতি ধীরে। এর মধ্যে চিঠি ধরা
পরার ভয়টাও ছিল। চিঠির যুগ থেকে মোবাইল ফোনের যুগ অনেক দ্রুত ও নিরাপদ। আমাদের
সন্তানরা আজও দরখাস্ত লেখে। চিঠি লেখে। কিন্তু তা লেখে পরীক্ষার খাতায়। বাস্তবে
তাদের তেমন একটা লিখতে হচ্ছে না বা প্রয়োজনই হচ্ছে না। আমরা কবিতা আবৃত্তি,
বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা ইত্যাদির আয়োজন করি।
আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে, উপস্থিত বক্তৃতার মত আমরা স্কুল
কলেজে চিঠি লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারি, কারণ চিঠি লেখার অভ্যাস সাহিত্য
রচনায় অনুপ্রেরণা দিবে। অপর দিকে মনের ভাবকে সুন্দর ভাবে লিখে ও গুছিয়ে উপস্থাপনা
করার কিছুটা চর্চা হবে। ইতিহাস থেকে সৃজনশীল চিঠির লেখনী হারিয়ে যায়নি। কেবল মাত্র
তা রূপ ও মাধ্যম বদল করেছে। তাই হারিয়ে যাওয়া চিঠি লেখার অভ্যাস এখন প্রতিযোগিতা ও
অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পুন:জাগরিত করার উপায় বের করতে হবে। এতে আমাদের বংশধরদের
সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
No comments:
Post a Comment