বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর হলে এবং স্বাভাবিক
মৃত্যু সৌভাগ্য থাকলে আমার বয়সীরা (২০১৫ সালে লিখছি) জীবনের দুই তৃতীয়াংশ (৪০ থেকে
৪৫ বছর) পার করে ফেলেছি। কখন যে সময়টা চলে গেল এবং যাচ্ছে তা আমাদের অজান্তে।
কয়েকদিন পরে হয়ত স্বাভাবিক নিয়মে আমরা একে একে পরাপারে যেতে থাকব। বৃদ্ধ আশ্রম
শুনলেই বৃদ্ধরা চমকে যায়। মনে হয় তাদের কেউ নাই । সন্তানরা নির্দয়। জেলখানা
সমতুল্য স্থানে তাদের ফেলে রাখা হয়। অথচ অনেক বৃদ্ধ/বৃদ্ধার সাথে বৃদ্ধা আশ্রমে
সবাই ভাল থাকার কথা কারণ কবির কথায় “মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে
সুর অসুর”। আমরা যদি চমৎকার পরিবেশের একটা ছোট ছোট ফ্লাটের বাড়ী তৈরি করে আর সে
সকল বাড়ীগুলোতে আমরা অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধা একসাথে থাকি তাহলে কেমন হবে? অনেকের সন্তান ও নাতি নাতনি ফেলে থাকতে না পারলেও আমার মত অনেকের কাছে
পরিবেশটা মন্দ মনে হবে না। এই আনন্দ আশ্রমটি হতে পারে ব্যস্ততম শহরের বাইরে কোন
নিরিবিলি স্থানে। আমার মাথায় এ ধারনা আসার কারণ আছে। আর তা হল আমার নিকটবর্তী একজন
আত্মীয় আছেন তিনি ও তার স্ত্রী ঢাকায় থাকেন। সন্তানরা থাকে মালয়েশিয়া ও আমেরিকায়।
আমার পিতার রিটায়ারের পর ঢাকা ছেড়ে আমার পিতা ও মাতা গ্রামের বাড়ীতে থাকেন। তারা
নিজেদের মত ছোট্ট সংসার পরিচালনা করছেন। লোকজন রেখে নিজেদের মত জীবন ধারণ করছেন।
কারণ আমার পিতামাতা ও সেই নিকটাত্মীয় কেউই সন্তানের সংসারে থাকতে আগ্রহী নয়।
স্বামী স্ত্রী বেচে থাকায় তারা পরস্পর সাপোর্টে নিজেরাই চলার পথ বের করেছে। আজ
থেকে ১৫ বছর পর আমিও আমার ক্ষেত্রে এ সিচুয়েশন চিন্তা করতে পারি। আমার মেয়ের বিয়ে
হয়ে গেল। ছেলেরা দুরে নিজেদের মত বিভিন্ন দেশে চাকুরী করবে। কালে ভদ্রে বেড়াতে
আসে। আমি আর স্ত্রী যদি গড় আয়ুতে বাচতে পারি, তবে পরস্পরের
সাপোর্টে আমরা বাঁচব। এক ছেলের কাছে আমি অন্য ছেলের কাছে আমার স্ত্রী অথবা
তিনমাস/ছয়মাস করে রোটেশন করে ছেলে মেয়ের সংসারে থাকা এটা অনেকের কাছে ঠিক
গ্রহণযোগ্য নয়। গ্লোবালাইজেশনের যুগে সন্তানদের কাছে পাওয়ার বা সন্তানদের সংসারে
থাকার চিন্তাটা হয়ত কমিয়ে দিতে হবে।
আমি আমার জীবনে উপরের যে পরিস্থিতি চিন্তা করেছি। তা হল।
আমার সন্তানরা সবাই দূরে দূরে থাকবে। কালে ভদ্রে তারা আমাদের দেখে যাবে। এমন
অবস্থায় আমার মত কয়েকজনকে নিয়ে একটা আশ্রম করলাম। এ আশ্রমের নাম দিলাম “আনন্দ
আশ্রম”। কারণ আমাদের এই বৃদ্ধা আশ্রমটি হবে এমন যেখানে আমাদের দুইটি রুম থাকবে
একান্তই নিকটাত্মীয় আসলে যেন আমাদের সাথে থাকতে পারে। বেশী গেস্ট আসলে রেস্টুরেন্ট টাইপ ডাইনিং থাকবে। সেখানে খাওয়া দাওয়া চলবে।
এছাড়াও কমন গেষ্ট রুম অনেক থাকবে তাতে গেস্টরা হোটেলের মত ভাড়া দিয়ে থাকবে। আমি
দুই রুমের স্টুডিও এ্যাপর্টমেন্টের পরিকল্পনা দিচ্ছি। হয়তবা কক্সবাজারে বিভিন্ন
হোটেলে এ ধরনের দুইরুমের ছোট ছোট এ্যাপার্টমেন্ট দেখা যায়। ছোট বাসায় থাকার কারণে
বৃদ্ধ বয়সে বড় বাসা থেকে ছোট বাসা রক্ষণাবেক্ষণে বেশী সুবিধা হবে। এছাড়া বৃদ্ধরা
তাদের বড় বড় বাসাগুলি ভাড়া দিয়ে কম খরচে
স্টুডিও ফ্লাটে অনেকের সাথে আনন্দে থাকতে পারবে। অনেক লোকজন রেখে অনেক টাকা
খরচ করে তাদের বড় বাসা রাখতে হবে না। অনেক নিকট আত্মীয় আসলে তারা সহজেই ভাড়া দিয়ে
গেস্ট রুমে রাখতে পারবে। তাদের আর বড় বাসা মেন্টেইন করতে হবে না।
মনে করি আমরা প্রায় ২০০/৩০০ ষাট উর্ধ্ব বৃদ্ধ পরিবার এমন
পরিবেশে থাকব। যেখানে নীচের সুবিধাগুলি থাকবে।
১. প্রতিটি স্টুডিও ফ্লাটে রান্নার ব্যবস্থা থাকবে যেন
ইচ্ছেমত টুকটাক রান্না করা যায়। আবার রেস্টুরেন্ট ও ডাইনিং এর ব্যবস্থা থাকবে যেন
শরীর খারাপ থাকলে বা রান্না করতে ইচ্ছে না করলে ডাইনিং এ খাওয়া যায়।
২. প্রতি ফ্লাট হোটেলের মত কেন্দ্রীয় ভাবে ঝাড়ুদার
পরিষ্কার করে দিবে।
৩. লন্ড্রি সার্ভিস থাকবে।
৪. চুলকাটার জন্য জেন্টস সেলুন ও মহিলাদের জন্য মহিলা
সেলুন থাকবে।
৫. ব্যক্তিগত গাড়ী রাখার পার্কিং থাকবে আবার ভাড়ায় গাড়ী
নেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
৬. সবার রুমে টিভি থাকবে আবার হল ঘরেও কেন্দ্রীয় ভাবে
দেখার জন্য টিভি থাকবে।
৭. পুরুষ ও মহিলা আলাদা আলাদা নামাজের স্থান থাকবে।
৮. নার্স ও ডাক্তার ২৪ ঘণ্টা থাকবে। এ্যাম্বুলেন্স
থাকবে।
৯. হাটার জন্য পর্যাপ্ত লন ও পার্ক থাকবে।
১০. যাদের ইচ্ছে বাগান করার জন্য ব্যবস্থা থাকবে।
১১. সন্তানদের সাথে যোগাযোগের জন্য হাই স্পীড ইন্টারনেট
থাকবে।
১২. ব্যায়ামের জন্য ট্রেইনার ও জিম থাকবে।
১৩. সুইমিং পুল, ছোটখাটো গলফ অনুশীলন,
যত ধরনের খেলা বৃদ্ধরা খেলতে চায় তার ব্যবস্থা।
১৪. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা থাকবে।
১৫. সকল পত্রিকা ও লাইব্রেরী থাকবে।
আমার আর মনে পরছে না। আরো অনেক অনেক বিষয় যোগ করা যায়।
বৃদ্ধ বৃদ্ধারা কমিটি করে পুরো প্রতিষ্ঠানটি সমবায় নীতিতে চালাবেন। তাদের কেউ
ক্যাটারিং দেখবেন। কেউ হেলথ দেখবেন। কেউ লাইব্রেরী দেখবেন। কেহ মেরামত ও
রক্ষণাবেক্ষণ দেখবেন। কেউ ডাক্তার থাকলে তিনি ডাক্তারি করবেন।অর্থাৎ যে যেটায় দক্ষ
সেটাই দেখবেন তার জন্য সন্মানী গ্রহণ করবেন। এতে একধরনের কর্মচঞ্চল পরিবেশ তৈরি
হবে। বৃদ্ধ বৃদ্ধরা অবসরের মধ্যে নতুনভাবে চাকুরী করা শুরু করবেন।
এখানে বৃদ্ধরা কেন থাকবেন? তারা থাকবেন আনন্দের
জন্য। একা একা না থেকে আরো অনেক বৃদ্ধা বৃদ্ধার সহচর্যে আনন্দে থাকবেন। অসুখ
বিসুখে পরস্পর সহায়তা করে একটা চমৎকার পরিবেশ তৈরি হবে। অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধা অনেক সম্পদের মালিক হলেও অনেক অযত্ন ও অবহেলায় পরে
থাকে। এই স্টুডিও ফ্লাটগুলো ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কেউ এর
মালিকানায় থাকবে না। বৃদ্ধরা বোর্ড করে এর উন্নয়ন ও মেরামত করবে। সকলে স্টুডিও
এপার্টমেন্ট/ ফ্লাটগুলোর ও অন্যান্য সেবার জন্য ভাড়া দিবে। সন্তানদের প্রয়োজনে যে
কেহ যে কোন সময় চলে যেতে পারে। পুনরায় আসতেও পারে। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ মারা
গেলেও সিঙ্গেল থাকতে পারেন। মূলত এটা বৃদ্ধ ও সামর্থবানদের ভাড়া বাড়ী। যেখানে ৬০
বছরের উপরে লোকজন থাকবে। কারণ ৬০ বছরের উপরের মানুষদের বেশী সাপোর্ট প্রয়োজন হয়।
স্বামী ও স্ত্রী যে কেউ ৬০ বছর পূর্ণ করলেই আনন্দ আশ্রমে থাকার যোগ্যতা অর্জন
করবে। বৃদ্ধরা আত্মীয় স্বজনকে নিদিষ্ট
সময়ের জন্য নিজ ফ্লাটে বা গেষ্টরুমে রাখতে পারবে। তবে লাগাতার আত্মীয় স্বজন রাখতে
গেলে প্রতিষ্ঠানের মহাত্ব ক্ষুন্ন হবে। কারো যদি কোন সন্তান অতিরিক্ত চাহিদা
সম্পন্ন হয় তবে এরাও পিতা মাতার সাথে থাকার ব্যবস্থা থাকবে।
অন্যান্য বৃদ্ধ আশ্রমের সাথে এর পার্থক্য এখানকার
বৃদ্ধরা সামর্থবান ও তারা ভাড়া করা
স্টুডিও ফ্লাটে নিজ বাড়ীর মত থাকবে। এটা একা একা বাসায় থাকা বৃদ্ধদের
সংঘবদ্ধ করে কর্মমুখী করে আনন্দময় পরিবেশ তৈরী করবে। এতে বৃদ্ধ বৃদ্ধরা যে যার মত
থাকবে। শুধুমাত্র বৃদ্ধ বয়সে যা যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থা থাকবে এবং বৃদ্ধরা একসাথে
আনন্দ করবে। তাই এর নাম বৃদ্ধ আশ্রম না হয়ে আনন্দ আশ্রম নাম দেয়া হবে। কারণ এখানে
এটা নিশ্চিত করা হবে যে যেভাবে বৃদ্ধ বয়সে থাকতে চায় তাকে সেভাবেই রাখা হবে। যেন
সকলেই আনন্দে থাকতে পারে এবং আনন্দময় জীবনে দীর্ঘজীবী হতে পারে।
এ ধরনের
আনন্দ আশ্রম বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের ব্যস্ততার কারণে অবহেলা থেকে দূরে রাখবে। একই
বয়সী অনেক বন্ধুদের মাঝে থেকে মনটা প্রফুল্ল থাকবে। সবাই আনন্দ আশ্রমটি চালাতে
নিজেরাই ব্যস্ত থাকবে। দিন যাক দেখা যাক আমার এই প্রস্তাবে ভবিষ্যতে কেমন সাড়া পাই
। আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলাম। যেদিন আমাদের দেশের প্রতিটি শহরে বৃদ্ধা
আশ্রমের বদলে বৃদ্ধরা থাকবে “আনন্দ আশ্রম”। অনেক বৃদ্ধ সকসাথে থাকলে বাধর্ক্য আর
কষ্টকর মনে হবে না। হেসে খেলে আনন্দে পরাপারে যাত্রা করা যাবে।
No comments:
Post a Comment