গত
১৪মে ২০১৪ রাতে আমরা কুষ্টিয়া থেকে বিজিবি অফিসাররা ডিসি কুষ্টিয়ার পক্ষ থেকে
সার্কিট হাউসে দাওয়াত পাই। উপলক্ষটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এ্যামবেসেডর ড্যান মজিনার
কুষ্টিয়ায় আগমন। ড্যান মজিনা গাজীপুরের কাপাসিয়ার লোহাদি গ্রামের একটি সোলার
সিস্টেমে গত ৯ মে ২০১৪ তারিখে ভিজিট করেছেন। পরে পত্রিকায় জানতে পারলাম, ফেরার পথে তার গাড়ী দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছিল।
ড্যান
মজিনা গাজীপুরের কাপাসিয়ার লোহাদি গ্রামের সোলার সিস্টেমের পরিদর্শনের,অভিজ্ঞতায় বললেন, তিনি কাপাসিয়ার সৌর ব্যবস্থায় “বাংলাদেশের নতুন ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছেন” আমি তখন
তাকে বললাম, আপনি যদি দৌলতপুরের চরে যান তবে দেখতে পাবেন, প্রত্যেকটি বাড়ীতে সোলার সিস্টেম আছে। তদুপরি
বাংলাদেশের এমন কোন বাড়ী নেই যাদের হয় বিদ্যুৎ আছে নয়ত সোলার সিস্টেম আছে। আমি
তাকে রাতের কঙ্গোর অন্ধকার জগতের বর্ণনা করলাম। কঙ্গোতে অত্যন্ত উচ্চমূল্য চায়না
থেকে আমদানি করা সোলার সিস্টেম কিনতে হয়। সেখানে আমরা বাংলাদেশে সোলার সিস্টেম
তৈরি করা শুরু করেছি এবং প্রতি ওয়াট সোলারের মূল্য এক ডলারের নীচে চলে এসেছে।
ড্যান
মজিনা সবকিছু শুনে বললেন, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় আমি ভবিষ্যৎ দেখেছি
এজন্য নয় যে তারা গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করছে। তারা এমন কিছু চালু করেছে যা আমাদের
প্রচলিত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাপনাকে বদলে দেবে যা কিনা ন্যানো গ্রিড সিস্টেম।
তিনি আরো বললেন, তারা বিদ্যুৎ বিতরণে প্রিপেইড মিটার ব্যবহার
করছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য হাইব্রিড সিস্টেম করেছে। এর জন্য মাত্র ৮
লক্ষ টাকায় ৫০ টি পরিবারকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে।
আমি
ইন্টারনেট হতে পড়াশোনা করে আর বিজিবি'র তিন কিলোওয়াট সিস্টেম দেখেছি এ অভিজ্ঞতায় মজিনাকে
বললাম, প্রথমে সোলার থেকে ১২ ভোল্ট ব্যাটারিকে
চার্জ করে তা থেকে আইপিএস এর মাধ্যমে ডিসি কে এসিতে রূপান্তর করে পরে তারের
মাধ্যমে বিভিন্ন বাড়ীতে সোলার বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। মজিনা বললেন, তিনি এটা জানেন। কিন্তু তিনি যা দেখেছেন তা আলাদা রকম
কিছু। যা হল ২২০ ভোল্টের ডিসি গ্রিড ও প্রিপেইড মিটার । এতে লাইট, টিভি ও ল্যাপটপ চলছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে।
গত ১৪
মে ২০১৪ তারিখ রাত থেকে মজিনার “২২০ ভোল্ট ডিসি গ্রিড” কথাটি আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। রাতে
ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে ২২০ ভোল্ট ডিসি গ্রিড সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পেলাম না।
পরদিন ১৫ মে অফিসে গিয়ে অপারেটরকে বললাম, গাজীপুরের কাপাসিয়ার ইউএনও সাহেবের মোবাইল নম্বর বের কর।
যদিও জানি কাপাসিয়া উপজেলার ওয়েবসাইটে গেলে আমি ইউএনওর নম্বরটা সহজেই পাব। তবুও
অপারেটরকে কাজ দেয়া আর কি। ঘন্টা খানেক পর অপারেটর নম্বরটা দিল। ইউএনওকে নিজের
পরিচয় দিয়ে, কাপাসিয়ার ড্যান মজিনা যে সৌর সিস্টেম
দেখেছেন সে সংস্থার কারো মোবাইল নম্বর চাইলাম। ইউএনও এই এলাকার চেয়ারম্যানের
মোবাইল নম্বর দিলেন। অতঃপর বাবলু চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সোলারিক কোম্পানির
স্বত্বাধিকারীর দিদার ভাইয়ের মোবাইল নম্বর পেলাম। “ভাই” এজন্য বানিয়ে ফেললাম কারণ তিনি ঝিনাইদহ
ক্যাডেট কলেজের বড় ভাই। অর্থাৎ ক্যাডেট কলেজের “ভাইয়া গ্রুপের” আর আমি বরিশাল ক্যাডেট কলেজের।
আমি
ছোট্ট পরিচয়ে উনাকে বললাম, আমি আপনার ২২০ ভোল্ট ডিসি গ্রিড সম্পর্কে
জানতে চাই। ইতিমধ্যে আমি উনার ওয়েবসাইটের সন্ধান পেয়েছিলাম। ওয়েবসাইটের সংবাদগুলো
থেকে “সোলারিক” শব্দটা পেয়েছিলাম আর এটা দিয়ে সার্চ দিয়ে তার ওয়েব সাইট
পেয়ে যাই। ওয়েবসাইটি হল: http://solar-ic.com. আমি
উনাকে বললাম, কুষ্টিয়া বিজিবি,র কিছু ক্যাম্প আছে পদ্মার পারে ও পদ্মার
চরে, যেখানে অনেক অনেক বসতি আছে যারা হোম সোলার
সিস্টেমে চলে। তাদের এলাকায় ন্যানো গ্রিড সিস্টেম করা সম্ভব কিনা। আমি এ বিষয়ে
অফিস টাইমের বাইরে রাতে ফোন করব বলে জানালাম। ইতিমধ্যে লাঞ্চের পরে উনার ওয়েবসাইট
ও ভিডিও দেখে ডিসি গ্রিড সম্পর্কে কিছুটা ধারনা নিতে পারলাম।
তারপর
আমার কোয়েরিগুলো নোটবুকে লিখে তাকে মেসেজ করলাম, আপনার কাছ থেকে ২০ মিনিট চাচ্ছি। আপনি যখন ফ্রি আমাকে কল
বা মিস কল দিন। রাত আনুমানিক ৮টায় কল পেলাম। আমি লাইন কেটে কল ব্যাক করলাম। তিনি
আমার প্রশ্নগুলি একে একে উত্তর দিতে থাকলেন। তিনি দীর্ঘ ৫১ মিনিট সময় নিয়ে আমাকে
বুঝলেন। তার সংক্ষিপ্তসার নীচে তুলে ধরছি:
১।
আমাদের ব্যবহার্য প্রায় সকল সামগ্রী ২২০ ভোল্ট এসিতে যেমন চলে তেমনি ডিসিতে চালানো
যাবে। মোবাইলের চার্জার,ল্যাপটপ,আগের মডেলের ফিলামেন্ট বাতি( ইনকেনডিসেন্ট), এনার্জি সেভিং টিউব লাইট ইত্যাদি অনেক সামগ্রী। এগুলো
১২০-২২০ ডিসির মধ্যে চলবে।
২।
আমাদের সব সামগ্রী যদি ডিসিতে চলে তবে ডিসি সোলার সিস্টেম ও ডিসি ব্যাটারিকে এসি
পাওয়ারে কনভারসন করার প্রয়োজন নেই। কারণ এসির সামগ্রীগুলো সমপরিমাণ ডিসি দিয়ে
চলবে। ডিসি কে এসি করতে ইনভার্টরে যে পাওয়ার লস হয় তা থেকে সোলারে উৎপাদিত
মূল্যবান বিদ্যুতকে রক্ষা করা যায়।
৩। এসি
বৈদ্যুতিক পাখা ডিসিতে চলবে না। তাই ডিসি পাখা ব্যবহার করা ভাল। অন্য দিকে এসি
পাখার ওয়াট হল ৮০ আর ডিসি পাখার ওয়াট হল ২০। সুতরাং এসি পাখার সমান বিদ্যুৎ
দিয়ে ৪টি ডিসি পাখা চালানো যাচ্ছে। তাই ব্যাটারির ডিসিকে এসি করে এসি মটর চালানোর
চেয়ে সরাসরি ডিসি মটর ব্যবহার করা যায়।
৪।
ব্যাটারির ডিসি ভোল্ট(১২ ভোল্টকে) বেশিদূর নেয়া যায় না এর বিপরীতে ১২০-২২০ ভোল্ট
ডিসি এসির মতই দুরে বিদ্যুৎ নেয়া যায়। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে পাঠানো সম্ভব
হয়েছে।
৫।
সিস্টেম লস ও অন্যান্য সমস্যা মুক্ত রাখার জন্য তার আন্ডার গ্রাউন্ড করা যাচ্ছে।
এসি তার আন্ডারগ্রাউন্ড সমস্যা কিন্তু ডিসিতে সাধারণ চিকন তার পিভিসি পাইপের মধ্যে
দিয়েই আন্ডারগ্রাউন্ড করা যাচ্ছে।
৬।
ক্যাপাসিটি বাড়াতে প্যারালালি পাওয়ার জেনারেশন বা লোড বৃদ্ধি করা যাবে অনেকটা
প্যারালাল-ভাবে ব্যাটারির সংযোগ দেয়ার মত। এসি সিস্টেমে এ ধরনের সংযোগ জটিল। এমনকি
পুরো সিস্টেম বদল করার প্রয়োজন পড়বে।
৭। ৪৮
ভোল্ট ডিসি থেকে ২২০ ভোল্ট ডিসিতে করভারশন করা হয় সেখানে লস কমানোর জন্য সেন্সরের
মাধ্যমে লোড অনুযায়ী পাওয়ার মডিউলের সক্রিয় থাকার সংখ্যা কম বেশী করে বিদ্যুৎ লস
আরও দক্ষতার সাথে কমানো হয়। যা কিনা অত্যন্ত আধুনিক ও দক্ষ প্রযুক্তি। এভাবে সোলার
সিস্টেমের মূল্যবান বিদ্যুতের ব্যবহারিক অপচয় ব্যাপকভাবে রোধ করা যায়।
৮।
প্রতিটি গ্রাহককে অনলাইন সিস্টেম,সার্ভার
ও জটিল নেটওয়ার্ক ছাড়া অল্প খরচে প্রিপেইড মিটার দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
৯।
ডিসি গ্রিড হল অদূর ভবিষ্যতের সবচেয়ে উপযোগী ব্যবস্থা যা কিনা বিদ্যুতকে অত্যন্ত
দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে।
আমি
জনাব দিদার ভাইয়ের তথ্যগুলি নিয়ে আমার মত ইন্টারনেটে গবেষণা করতে বসলাম। আমি ডিসি
ট্রান্সমিশন নিয়ে যা পেলাম তা এক এক করে তুলে ধরছি:
১।
ডিসি ট্রান্সমিশন সিস্টেম ধারনা করা যায় এটা আগামী শতকের প্রযুক্তি কারণ গিগা-ওয়াট
বিদ্যুৎ কম লসে ও কম খরচে ডিসি গ্রিডে পরিবহন সম্ভব। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ
পাওয়ার ট্রান্সমিশন হচ্ছে HVDC সিস্টেমে রাশিয়ায় ও চীনে।
২। এসি
গ্রিড হতে ডিসি গ্রিডে সবচেয়ে বেশী দূরত্বে বিদ্যুৎ পরিবহন করা যায়।
৩।
আন্ডার গ্রাউন্ড বা সাগরের তল ডিসি বিদ্যুতই বেশী দূরত্বে পরিবহন করা যায়। ৮০০
কিমি সাগরের নীচ দিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে আর ৫০ কিমি বেশী এসি বিদ্যুৎ
আন্ডারগ্রাউন্ড বা সাগরের নীচ দিয়ে নিতে স্কিন এফেক্ট ও ইনডাকশন লসের জটিল সমস্যায়
পড়তে হয়।
৪।
ডিসি পাওয়ারে ট্রান্সমিশন এসি থেকে নিরাপদ।
৫।
ডিসি পাওয়ার ট্রান্সমিশন এসি থেকে সাশ্রয়ী।
৬। তবে
ডিসি পাওয়ায় ট্রান্সমিশন সফল না হওয়ার পিছনে মূল কারণ পাওয়ার স্টেপ আপ ও স্টেপ
ডাউন ডিসি ট্রান্সমিশনে খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল। এই কারণে ডিসি সিস্টেম মোটেই
জনপ্রিয়তা পায়নি। এসি ট্রান্সমিশন অত্যন্ত সহজ ও কম ব্যয়বহুল। খুব সহজেই কয়েল
পেঁচিয়ে যেখানে সেখানে এসি বিদ্যুৎ স্টেপ আপ ও স্টেপ ডাউন করা যায়। আয়রন কোরে
ইনডাকশনের মাধ্যমে বেশী প্যাচ দিলে বেশী ভোল্টের বিদ্যুৎ আর কম প্যাচ দিলে কম
ভোল্টের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ট্রান্সফরমারে মোটা তার দিলে বেশী এ্যাম্পিয়ারের
বিদ্যুৎ আর চিকন তার দিলে কম এ্যাম্পয়ারের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ।
৭।
ভবিষ্যতে পৃথিবীব্যাপী ব্যাপকভাবে ডিসি ট্রান্সমিশনের চিন্তা চলছে কারণ ডিসি
ট্রান্সমিশনের স্টেপ আপ ও স্টেপ ডাইন করার জটিলতা সাশ্রয়ী প্রযুক্তিতে রূপান্তর
হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে ১০০ বছর পরের যে প্রযুক্তি অর্থাৎ ডিসি গ্রিড সিস্টেম চালু হওয়ার আশা
করছেন সেখানে কাপাশিয়ার পল্লীর কুঠিরে সে প্রযুক্তি দেখে যুক্তরাষ্ট্রের
এ্যামবেসেডর বলেছেন,”তিনি
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছেন”
বাংলাদেশের
ভবিষ্যতকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সকলের কাছ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা
পেতে পারেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেট ও সোলারিক কোম্পানির
স্বত্বাধিকারী জনাব দিদারুল ইসলাম। উনার বেশ কিছু আবিষ্কারের প্যাটেন্ট রয়েছে।
আমরা তাঁর ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উন্নতি কামনা করি। আপনারা সময় পেলে
সোলারিক কোম্পনীর ওয়েবসাইট ভিজিট করবেন।
No comments:
Post a Comment